আমার অগ্রজ প্রখ্যাত ছড়াকার মিলু কাশেম

“বড় ভাইয়ের জন্মদিনে”

৭০ দশকের খুরধার ছড়াকার আবুল কাশেম মিলু আমার অগ্রজ। আমরা ছয় ভাই চার বোনের মধ্যে তিনি সকলের বড়। আমি তাঁর সহোদর না হলে হয়তো সাহিত্যের মায়াবী জগতের সাথে আমার পরিচয়ই হতোনা।
আমি বেড়ে উঠেছি তাঁর ছন্দের তালে তালে। বর্ণমালা শেখার আগে তাঁর ছন্দ আমাকে দোলা দিয়েছে। আমার অবুঝ প্রাণকে আকুল করেছে।আমার মনে আছে আট নয় বছর বয়সে তাঁর মুখে শুনে শুনে আমি তার একটি ছড়া সে সময় মুখস্ত করেছিলাম, সেই ছড়া এখনো আমার প্রাণকে দোলা দেয় ।লাল টুকটুক আলাতা পায় / যায়রে খুকু সোনার নায়/ নায়ের উপর রাঙা ছই/ পড়ছে খুকু ছড়ার বই/ পত পত উড়ছে পাল/ শক্ত করে ধররে হাল/ তা-ধিন ধিন তা-ধিন ধিন ঢোলক বাজায় টিয়ে/ দোয়েল শ্যামা গাইছে গান ময়না পাখির বিয়ে”।

আমার জীবনের শিউলি ফোটা ভোরে বড়ভাই আমার হাতে তুলে দেন যোগীন্দ্রনাথ সরকারের “খুকুমনির ছড়া” সেই ছোট্র চটি বইটির ছন্দ আমার হৃদয়ে আলো ছড়ায়। বড়ভাই তখন দুই হাতে ছড়া লিখছেন। ঝরঝরে ভাব,ভাষা, প্রখর কল্পনা শক্তি, এবং তীক্ষ্ণ জীবন দৃষ্টি নিয়ে বাংলা ছড়ার মাঠে খই ফুটান। শিশুতোষ বিষয় ছাড়াও সে সময় তিনি অনায়াসে তাঁর শিল্পমাধ্যম ছড়ায় তুলে আনেন সমাজের অনেক অসঙ্গতির চিত্র।ভাব বৈচিত্রের পাশাপাশি তিনি ছন্দ নিয়ে পরিক্ষা নিরিক্ষা চালান। অত্যন্ত সহজ সরল ভাবে তার রচনায় তিনি উপস্থাপন করেন জীবন বোধ এবং সাধারন মানুষের আশা আকাংখাকে। ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে তার ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশময়। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ছাড়াও পশ্চিম বঙ্গের অনেক গুলো কাগজে নিয়মিত তাঁর ছড়া প্রকাশিত হতো। ছাপা হওয়ার পরে আমরা ভাইবোন সবাই মিলে পড়তাম। সে সময়ের অনেক ছড়া এখনো আমার মনে আছে। হয়তো ওনার কাছে এসব লেখার কোন কপি নেই কিন্ত আমার হৃদয়ে এখনো ভাস্বর। ১৯৭৫ সালের আগে আমি শুধু বিদ্রোহী কবি নজরুলের নাম শুনেছিলাম। “ভোরহলো দোর খোল” আর কাঠবেড়ালী ছাড়া তাঁর কোন লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়নি তখনো। বড়ভাই সেসময় একবার ঢাকায় গিয়ে অসুস্থ নজরুলকে দেখে এসেছিলেন । আমাদের বাসার সবাই তখন মুগ্ধ হয়ে তাঁর মুখে কবি দর্শনের গল্প শুনেছিলাম। এর কিছুদিন পরই বিদ্রোহী কবি এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। সেসময় হৃদয়স্পশী একটি কবিতা বড়ভাই লিখেছিলেন। ” বধর্মানের আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রাম/ সেই গ্রামেরই একটি ছেলে দুখু ছিলো তার নাম ….” । সেই কবিতায় নজরুলের পুরো জীবন চিত্রায়িত হয়েছিলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কবিতাটি অসংখ্যবার পড়েছিলাম। কবি জসিম উদ্দিনের উপর এরকম আরেকটি কবিতা ছিলো তাঁর। এইসব কবিতার মাধ্যমে বাংলার কবি আর কবিতার প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মে। আমার কৈশোরে আমি অনেকদিন আমাদের গ্রামের বাড়ীতে ছিলাম। আমার খালার কোন সন্তান ছিলোনা তাই বাবা মা আমাকে তার কাছে দিয়ে দেন। বাবা মা ভাইবোন সবাইকে শহরে রেখে আমি খালার কাছে থাকাতম সৈয়দপুরে। সেসময় প্রায় একমাস দুই মাস পর পর আমি আসতাম শহরে কয়েকদিনের জন্য। যখন ফিরে যেতাম বড়ভাই আমাকে ব্যাগ ভরে বই দিতেন্। নানান রকমের বই। আমাদের বাসা ছিলো তখন বইয়ের ভান্ডার। শিশু সাহিত্যের অনেক কাগজ তখন বাড়ীতে আসতো । শাপলা শালুক, ধানশালিকের দেশ,নবারুণ, কলকাতার আনন্দমেলা, তেপান্তর আরো রঙবেরঙের অনেক কাগজ । আমি গ্রামে যাওয়ার সময় এগুলো নিয়ে যেতাম। গ্রামের উদাস দুপুরে অথবা অন্ধকার রাতে হারিকেনের মিটিমিটি আলোর নিচে আমি হারিযে যেতাম সেইসব বইয়ের পাতায়। আর স্কুলের কোন অনুষ্টান হলেই বড়ভাইয়ের ছড়া পড়ে হাততালি কুড়াতাম। তাঁর ছড়ার তাল. ছন্দ যখন আমাকে দোলা দিত তখন আমার কাছে মনে হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ট লেখক আমার ভাই। এভাবে কখন কি রকম আমার অন্তর ছন্দময় হয়ে উঠে আমি বুঝতে পারিনি। তখন থেকেই তাঁর ছড়া আমাকে প্রভাবিত করতে থাকে, ঘুমে জাগরণে। আমি বেড়ে উঠি অগ্রজের ছায়ার ভেতরে। শুধু ছড়া নয় তাঁর আদর্শ ও আমাকে অনুপ্রাণীত করে । সে সময় তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িত। বাসায় ছড়া কবিতার সাথে রাজনৈতিক বইয়ের ছড়াছড়ি। সেই সুবাদে কৈশোরেই হাতে তুলে নেই ম্যাক্সিম গোর্কী,মহামতি লেলিন,এঙ্গেলস, ভিক্টর হুগো , নিকোলাই অস্ত্রভস্কি সহ বিশ্ব বরেন্য মানুষের গ্রন্থ । সত্তর দশকের শেষের দিকে ছড়াকার হিসাবে বড়ভাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশময়। দেশের বিখ্যাত লেখকদের সাথে তখন তাঁর যোগাযোগ। সেই সুবাদে অনেকে সে সময় আমাদের বাসায় আসেন নিয়মিত। আমরা ধন্য হই তাদের সাক্ষাতে। চাঁদের হাটের রফিকুল হক দাদু ভাই,প্রখ্যাত গীতিকার ফজলে খোদা, খালেক বিন জয়নুদ্দিন, শিশু সাহিত্যিক আলী ইমাম,ছড়াকার আবু হাসান শাহরিয়ার, লুৎফর রহমান রিটন, সৈয়দ আল ফারুক সহ দেশের অনেক লেখকদের সাথে আমার পরিচয় হয়।
সেসময় বড়ভাই এবং সিলেটের আরো কয়েকজন ছড়াকার মিলে সিলেটে ক্লাবে একটি ছড়ার অনুষ্টান করেন সম্ভবত সেটা সিলেটে প্রথম দশর্নীর বিনিময়ে ছড়াসন্ধ্যা। সে সময় তারা বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত ছড়াকারদের ছড়া পোস্টারে লিখে দেয়ালে টাঙিয়েছিলেন। অনেকের ছড়ার মধ্যে সুকান্তের ছড়াই বেশী ছিলো পোস্টারে। সেদিন দুটি পোস্টার আমাকে আকৃষ্ট করেছিলো খুব। সুকান্তের ” দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা/ আমি যে বেকার পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা”…। ভেজাল ভেজাল ভেজালরে ভাই / ভেজাল সারা দেশটায়/ ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়…। সেদিনের অনুষ্টানে তারা একটি ছড়া পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন নাম ছিলো ছড়া সন্দেশ। কাগজটি নিয়ে দুই বাংলায় অনেক লেখালেখি হয়েছিলো। একই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো “বাংলাদেশের ছড়াও ছড়া লেখক” নামে একটি গ্রন্থ। সম্পদনা করেছিলেন আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক এবং বড় ভাই।

যদিও বড়ভাই লেখালেখি শুরু করেছিলেন,সৈয়দ কাসেম মিলু নামে, পরবর্তিতে দৈনিক বাংলার শিশুকিশোর পাতা “সাত ভাই চম্পা”র সম্পদক আফলাতুন ভাইয়ের ধারালো কাচি তাঁর নামটি ছোট করে দেয় ।

( আমাকেও আফলাতুন ভাই আবু নাসের দিলু থেকে দিলু নাসের বানিয়েছেন)
এর পর থেকেই মিলু কাসেম নামে পরিচিতি লাভ করেন। সে শুরু থেকেই সাবলিল প্রাণ মাতানো শিশুতোষ ছড়ার পাশাপাশি অনেক রাজনৈতিক ছড়া লিখেন তিনি। তাঁর ছোট একটি ছড়া এখনো আমার মনে গাঁথা ” যাইনি ভুলে একাত্তরের যুদ্ধ/ বন্দী ছিলাম ভাইবোন বাপ সুদ্ধ / যাইনি ভুলে সেসব
কিছুই আমরা/সুযোগ পেলেই তুলবো গায়ের চামড়া/ লেখালিখির পাশাপাশি তিনি রাজনীতি করতেন গণমানুষের জন্য। গণমানুষের মুক্তির জন্য যেভাবে তাঁর কলম ছিলো উচ্চকিত, তেমনি কন্ঠ ছিলো সোচ্চার। স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের আমলে সিলেট থেকে তারা বের করেন রাজনৈতিক সাহিত্যের কাগজ “ডাক দিয়ে যাই” সেই কাগজ আমাদেরকেও অনুপ্রানিত করে। কিন্ত স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু তাকে রেহাই দেয়নি। একসময় তার উপর নেমে আসে জেল জুলুম। তার চেতনা ভেঙে দিতে দীর্ঘদিন তাকে আটকে রাখা হয় কারাগেরের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। সেসময়ের তাঁর অগ্নিঝরা লেখা গুলো আমাদের কাছে এখন আর নেই। আমাদের মা ভয়ে বড়ভাইয়ের অনেক লেখা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন সে সময়। হয়তো পুরনো কাগজ ঘাটলে পাওয়া যাবে সময়ের সাক্ষী সেইসব চিরন্তন অক্ষর গুলো। জেগে উঠার মন্ত্র। অত্যাচারী শাসকের রোষানল থেকে বাঁচতে এক সময় তাকে প্রিয় দেশ, প্রিয় মানুষের আঙিনা ছেড়ে পালাতে হয় সুদূরে। ভিন্ন দেশে ভিন্ন মাটিতে তিনি আবাস গড়েন। ইউরোপে দীর্ঘদিন অনিশ্চিত প্রবাস জীবনে থাকার কারণে তাঁর খুরধার লেখনিতে ভাটা পরে। কিন্তু সাদা কালো বাদামী মানুষের ভীড়ে প্রতিনিয়ত তার বুকে বাজে পদ্মা মেঘনার কলতান। আর বাউলের একতারা। দীর্ঘ দিন প্রবাসে থাকার পরে মাতৃভুমির টানে চাকচিক্যময় জীবন ফেলে তিনি ৯০ দশকে একেবারেই চলে আসেন দেশে। আর দেশ ছাড়া হননি। ইদানীং তার কিছু কিছু ছড়ায় ৭০এর তেজী দীপ্ত ছোঁয়া পাওয়া গেলোও
তাঁর ভ্রমণ কাহিনী এবং অনান্য গদ্য সাহিত্যে রয়েছে প্রাণের ছোঁয়া। পাঠকের কাছে বিপুল সমাদৃত হয়েছে তার প্রকাশিত বই গুলো। কিন্তু আমার কাছে তিনি এখনো প্রিয় ছড়াকার। আমার চেতনার উৎস। চৈতন্যের শানিত কুঠার।
আজ আমাদের বড়ভাইয়ের জন্মদিন। মহান আল্লাহর কাছে তার সুস্থতা এবং দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
দিলু নাসের
লন্ডন
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *