“সিলেটে পাথর ও বালি খেকোদের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব”

সিলেট নিউজ টাইমস্ ডেস্ক:: উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও থেমে নেই সিলেটে বালি ও পাথরখেকোদের তাণ্ডব। হাতে গোনা কয়েকজন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় সিলেটের দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলোর ৯৫ ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে।

জাফলংকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এখন জেলা প্রশাসনের নথিপত্রে জাফলংকে পাথর কোয়ারির তালিকায় রাখা হয়েছে।

এর পেছনে কোটি কোটি টাকা চাঁদার প্রভাব আছে। প্রভাবশালীদের পাশাপাশি উপজেলা পরিষদের ট্যাক্সের নামেও চাঁদা আদায় হয়।

অবৈধভাবে পাথর তুলতে গিয়ে গত ১৫ বছরে মৃত্যু হয়েছে ৯৪ শ্রমিকের। তবুও টনক নড়েনি স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতা ও চাঁদার সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের।

আদালতের নির্দেশনার পর অঘোষিত এই বালি ও পাথর মহাল পরিচালিত হয় শ্রমিকের কাঁধে ভর করে। সেই শ্রমিকদের কাছ থেকেও প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হয়।

প্রতিমাসে প্রায় ৬ কোটি টাকা তোলা হয় শ্রমিকদের কাছ থেকে। স্থানীয় প্রশাসনের একটি প্রভাবশালী চক্রকে ম্যানেজ করে গভীর রাতে নদীতে বোমামেশিনের মতো শক্তিশালী যন্ত্র বসিয়ে পাথর ও বালি তুলে নেয়া হচ্ছে।

রাত ১২টার পর থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নদীর তলদেশে গভীর গর্ত করে বালি ও পাথর তুলে বলগেট ভরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার বালিবাহী বলগেট বোঝাই করা হয় ইসিএ অন্তর্ভুক্ত এই নদী থেকে।

স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য চাওয়ার একদিন পরই জানানো হয় অবৈধভাবে বালি ও পাথর উত্তোলনের সব প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছে।

অবৈধ কাজে বাধা দেয়ায় জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বালু ও পাথরখেকোদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে কথা বলতেও তাদের কেউ কেই বিব্রতবোধ করেন। এক কর্মকর্তা বদলি হয়ে চলেও এসেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও তথ্যানুসন্ধানে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর সিলেটের জাফলং ডাউকি নদীকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করার নির্দেশনা দেন।

২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি জাফলং ডাউকি নদী ও নদীর উভয় পাড় থেকে ৫শ’ মিটার প্রস্থের এলাকা এবং জাফলং ডাউকি ও পিয়াইন নদীর মধ্যবর্তী খাশিয়া পুঞ্জীসহ ১৪ দশমিক ৯৩ বর্গমিটার এলাকাকে ইসিএ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে বেলার সিলেটের আঞ্চলিক সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা বলেন, স্থানীয় প্রশাসন ইসিএ গেজেট হাতে পেয়ে সীমানা নির্ধারণ করলেও ইসিএ বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

বরং তৎকালীন প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় ধ্বংসলীলা চলেছে ইসিএ এলাকায়। এদিকে গেজেট অনুযায়ী ইসিএভুক্ত এই এলাকা থেকে ‘যান্ত্রিক, ম্যানুয়াল বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে যে কোনো খনিজসম্পদ উত্তোলনসহ ৭টি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) হিসেবে গেজেটভুক্ত হওয়ার পর সেখানে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি মাছ ধরাও নিষিদ্ধ।

কিন্তু সেখানে অবৈধ বালি-পাথর উত্তোলন করে দুর্বৃত্তরা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। অবৈধভাবে আয় করছে কোটি কোটি টাকা।

জানতে চাইলে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় জনসাধারণ ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, প্রশাসনের কর্মকর্তারা আজ আছেন কাল নেই।

যে কোনো স্থানে খনিজসম্পদ আহরণ করার অনুমতি দেয়া কিংবা লিজ দেয়ার আগে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এ জন্যই প্রয়োজন এই সেক্টরে আলাদা কর্তৃপক্ষ।

আমি ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ মহলে প্রতিবেদন দেয়ার চিন্তা করছি। চাঁদাবাজ এবং যারা এসব ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে তাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ অংশে এমন বিধ্বংসী কার্যকলাপ হলেও ভারতীয় অংশ এখনও অক্ষত আছে, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

যেভাবে চাঁদা নেয়া হয় : প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার বলগেটসহ ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌযান বোঝাই করা হয় নিষিদ্ধ এলাকা থেকেই। জাফলং ব্রিজের ওপর থেকে দিনের বেলায়ই ইসিএ অন্তর্ভুক্ত নদী থেকে বালু বোঝাইয়ের দৃশ্য দেখা গেছে।

একটি বড় বলগেট বোঝাই করতে চাঁদা নেয়া হয় দেড় হাজার এবং ছোট নৌযানে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। এখানেই শেষ নয়, উপজেলা পরিষদের ট্যাক্সের নামেও আছে চাঁদাবাজি।

এখানে প্রতি বলগেট থেকে ১২০০ এবং ছোট নৌযান থেকে ৮০০ টাকা নেয়া হয়। এ সময় চাঁদার টাকা সংগ্রহ করে বস্তায় ভরে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পাথর ব্যবসায়ী প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এই চাঁদাবাজদের বিস্তর তথ্য দেন। তারা বলেন, রাতে বোমামেশিন দিয়ে যে পাথর উত্তোলন হয়, তা ভোরবেলা বলগেটে ভরে পাথরের ওপর বালু দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয় ছাতকে।

এই চক্রের আলাউদ্দিন নামের এক সদস্যের বাড়ি সেখানে। তিনি সেই পাথর ও বালু বিক্রির টাকা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করেন।

জাফলংয়ের চিহ্নিত চাঁদাবাজ জামাই সুমন, আলাউদ্দিন, আলীম, ফিরোজ ও বিশ্বনাথী ফয়জুলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় অবৈধ বালু ও পাথরের এই হাট।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায়ও এদের নাম আছে। এরাই অবৈধ এ ব্যবসার গডফাদার। এক সময় এদের কিছুই ছিল না। অথচ গত পাঁচ বছরেই আঙুল ফুলে কলাগাছ বনেছেন।

নিয়ন্ত্রণ করেন জাফলংয়ের অপরাধ জগৎ। এমনকি গভীর রাতে নদীতে বোমামেশিন চালানোর সময় সাংবাদিকদের নজরদারি এড়াতে এক থেকে দেড়শ’ উঠতি বয়সী যুবককে সশস্ত্র পাহারায় রাখা হয়।

তাদের হাতে থাকে লম্বা দেশীয় ধারালো অস্ত্র। বিনিময়ে তাদের দেয়া হয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। এদের পেছনের শক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, একটি কলেজের অধ্যক্ষ মদদদাতা হিসেবে কাজ করছেন।

বিনিময়ে তিনি ও তার এক ভাই দৈনিক একটি ভাগ পান। এই ভাই সম্পর্কে জানতে চাইলে এক পাথর ব্যবসায়ী বলেন, প্রকাশ্যে গত ২২ জানুয়ারি একটি সভায় তিনি তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পিঠের চামড়া তুলে নেয়ার হুমকি দেন।

কারণ, তিনি অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। এরপরই ওই কর্মকর্তা বদলি হয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন।

উপজেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে হুমকি দেয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এরা যখন যে সরকার আসে সেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যায়। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না প্রশাসনও।

এ বিষয়ে সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত কুমার পাল বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে বিব্রতবোধ করছি। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নীতি অনুসরণ করেছি। সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মেনে চলেছি।’

সিলেট জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম অবৈধ বালি-পাথর পরিবহনে উপজেলা পরিষদের নামে নেয়া এই টাকাকেও অবৈধ বলেছেন।

তিনি বলেন, গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে রেজুলেশন করে এই টাকা আদায় স্থায়ীভাবে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, রাত ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত শক্তিশালী মেশিন চালানোর বিষয়টি সঠিক।

তবে এটা বোমামেশিন নয়, লিস্টার মেশিন বলে আমাকে জানানো হয়েছে। তথ্য পাওয়ার পর সেটা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে সিলেটে অবৈধ ও অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনের বিষয়ে এ বছর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) একটি প্রতিবেদন হাতে আসে।

৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনের এক স্থানে শ্রমিক মৃত্যুর বিষয়ে বলা হয়েছে: ‘২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলা, উতমাছড়া, ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছানাকান্দি, কানাইঘাটের লোভাছড়া ও জৈন্তার শ্রীপুরে পাথর উত্তোলনের সময় ৯৪ শ্রমিক নিহত হন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসপি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘যারা মারা গেছেন, সে বিষয়ে মামলা আছে। শ্রমিকদের যারা নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নিয়োজিত করেছে তাদের বিরুদ্ধে ৩০৪(খ) ধারায় মামলা নেয়া হয়েছে।

বেলার প্রতিবেদনে বলা হয় সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো থেকে এখন আর পাথর উত্তোলন করার মতো অবস্থা নেই। পাথর সমৃদ্ধ প্রতিটি এলাকা আজ বড় বড় গর্তে পরিণত হয়েছে। এসব অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। অন্যথায় সিলেটের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলা, ভোলাগঞ্জ, জাফলংয়ের মতো সীমান্তবর্তী দৃষ্টিনন্দন এলাকা।

সৌজন্যে : যুগান্তর

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *