‌ডাঃ মঈনের মৃত্যু এবং আমাদের শিক্ষা:মোঃ জামিউল আহমেদ


‌ডাঃ মঈন আর নেই। টিউশনি করে ডাক্তারী পড়েছিলেন। ছিলেন একজন অতি সাধারণ মানুষ। এসেওছিলেন সাধারণ পরিবার থেকে। তাই সাধারণরাই ছিল তার মেধায়, মননে এবং কর্মে। সেবা দিয়েছেন অকাতরে ধনী-গরীব নির্বিশেষে। নেননি কোন ফি এলাকার কোন গরীবের থেকে। পরিচিতি পেয়েছেন ‘গরীবের বন্ধু’ হিসেবে। আর ব্যবহার দিয়ে জয় করেছেন সতীর্থ, সহকর্মী ও সর্বসাধারণকে।

‌শুধু কি তাই? বন্ধুর পরামর্শে বিলেত যাওয়াও নাকি নাকচ করেছিলেন ঐ বোকা ডাক্তার। বলেছিলেন, যে দেশের জন্য আমি ডাক্তার এবং যে মানুষের ভালোবাসায় আমি সিক্ত তাদের ছেড়ে আমি যেতে পারবোনা। এভাবে হয়তো আরো অনেক কিছু জানা যাবে, সময়ের ব্যবধানে। কিন্তু ডাঃ মঈনকেতো আর পাওয়া যাবেনা। তাহলে তার এই না ফেরা কি আমাদের কাম্য ছিল? মোটেই না এবং কখনো না। তাহলে তিনি কি নিজেই তার মৃত্যুকে টেনে নিয়ে এসেছেন?

‌স্বার্থপরভাবে জবাব দিলে বলবো, হ্যা তিনি নিজেই তার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। নাহয় করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য এত আগ্রহী হবেন কেন। কেন অন্যদের মত নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারেন নি। না, তার পক্ষে তা যে সম্ভব ছিলনা। কারণ তিনি সত্যিকার একজন মানব প্রেমী, মানবতাবাদী এবং মানব সেবক। অথচ আমাদের নিজেদের বাঁচার প্রয়োজনেই তাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার ছিল। তারপরও এই মানুষটিকে আমরা বাঁচতে দেইনি। তাকে যেন ঠাণ্ডা মাথায় গলাটিপে হত্যা করেছি।

‌তা যদি না হবে তাহলে – কেন দায়িত্বরত এমন একজন ডাক্তারকে সুরক্ষার জন্য ঠিকমত পিপিই সরবরাহ করা গেলো না? কেন তাকে জেনেশুনেও অকেজো ভেনটিলেটর সমৃদ্ধ হাসপাতাল শামসুদ্দিনে শুইয়ে রাখা হলো? কেন তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভেনটিলেটর আর আইসিইউ সাপোর্ট দেয়া হলো না? কেন তাকে অন্তত জরুরী প্রয়োজনে আইসিইউ সাপোর্টেড এম্বুলেন্স দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো না? কেন তাকে তার ইচ্ছায় এবং বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে হলেও এয়ার এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে ঢাকার স্থানান্তর করা হলো না। কেন মরার পরেও তার মরদেহ একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সিলেটে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো না?

‌এসব অনেক প্রশ্নের সঠিক কোন জবাব কখনো পাওয়া যাবেনা এবং এটাই এদেশের নিয়ম। অবশ্য কিছু পাওয়ার আসায় ঐ বোকা ডাক্তার তাকে মানব সেবায় নিবেদিত করেননি। করেন নি বলেই নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে গেছেন। তাই বলে তার বাঁচার অধিকারটুকুতো এভাবে কেড়ে নেয়া যায়না। এজন্য তিনি একটা শিক্ষা নিয়ে গেছেন, যতই তিনি দেননা কেন তার মরণকালেও তাকে কেউ কোন কিছু প্রতিদান দেয়নি এমনকি এগিয়েও আসেনি। এতে তার কোন দুঃখ নেই, তাই নীরবে নিভৃত্বে আস্তে করে চলে গেছেন। তবে, আমাদের জন্য কিছু শিক্ষা রেখে গেছেন। তাহেলে দেখা যাক সেই শিক্ষায় কার কি হিস্যা।

‌একঃ ব্যক্তি
‌মানবসেবার জন্য ডাঃ মঈনের মত এভাবেই মেধা, মনন, সময় আর শ্রম সবই দিতে হবে অকাতরে। চলার পথে যে যাই বলুক, বিপদে এমনকি মরণকালেও কারো সাহায্য পাওয়া যাবেনা। তাই এসব মেনে নিয়েই এপথে পা বাড়াতে হবে। তবে, পরোকাল অবশ্যই তোমার নিজের জন্য থাকবে। এতে মরণের পর তোমাকে কেউ বাহবা দিক আর নাই দিক কিংবা শহীদ বলুক আর নাই বলুক তোমার পুরষ্কার তুমি ঠিকই পাবে।

‌দুইঃ পরিবার
‌পরিবারকেও মনে রাখতে হবে, তোমার কোন সদস্য সত্যিকার মানব সেবক তথা সমাজ সেবক হলে তাকে ঐ নামে এবং আল্লাহর হাতে সপে দিতে হবে। তার কাছে কিছুই আসা করা যাবেনা। কেন না সে পরিবারকে কিছুই দিতে পারবেনা এবং সম্ভবও নয়। উপরন্তু নানাভাবে সমস্যা এমনকি বিপদও ডেকে আনতে পারে। কারণ, মানুষ ঘরে হিরো হলে বাইরে হিরো হতে পারেনা। তেমনি বাইরে হিরো হলে ঘরে হিরো হতে পারেনা।

‌তিনঃ সমাজ
‌সমাজ তথা দেশবাসীকে মনে রাখতে হবে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে হয়। যতই স্বার্থপর হোন না কেন আপনার আশেপাশের সত্যিকার সৎ, জনদরদী এবং নিবেদিত প্রাণ মানুষগুলোকে চিহ্নিত করতে হয়। অন্তত নিজের প্রয়োজনে হলেও এদের লালন করতে হয়, সম্মান জানাতে হয় এবং বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এতে ঐ মানুষটি অন্তত অনুপ্রাণিত হয়, সাহস ও শক্তি পায়। নাহয় ডাঃ মঈনের মত একেবারে চলে গেলে শুধু আক্ষেপ বাড়ে কিন্তু কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা।

‌চারঃ রাষ্ট্র
‌আমি যেমনি হইনা কেন আমরা তেমনি না হলে রাষ্ট্র চালানো খুবই মুশকিল। আমি ভালো আর আমার সাঙ্গপাঙ্গ খারাপ তাতে কি হবে। আমি কলসিতে পানি ঢালছি আর পাহারাদার ফুটো করে দিচ্ছে, তাতে কি লাভ হচ্ছে। তাই আমি বললেই হয়না, প্রমাণ করতে হয়। সত্যকে লুকাতে নেই, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে নেই, এবং অবিচারকে আমলে নিতে নেই। এজন্য সব দায়দায়িত্ব শুধু সরকার প্রধান নয় রাষ্ট্রযন্ত্রকেও নিতে হয় এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। কেন না ছাগল দিয়ে হালচাষ হয়না এবং শেষ বিকেলে সবকিছু প্রধানের ঘাড়ে এসেই পড়ে। তখন এসব চাটুকার, খয়ের খাঁ, দালাল, সুবিধাবাদী, জ্ঞানপাপী, ধর্মরাজি কেউই পাশে থাকেনা। কারণ, সময় বড় বিচারক এবং সত্য বড় নির্মম। তাই এক সময় মানুষ কেন প্রকৃতিও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করে। তখন কোন শক্তি সামন্ত আর তন্ত্র মন্ত্র কিছুতেই কিছু হয়না।

‌পাচঃ সিলেটবাসী
‌আমরা ডাঃ মঈন উদ্দিনকে হারিয়ে একজন পরিক্ষিত ও সময়ের সেরা সাহসী সৈনিককে হারিয়েছি। এখন হায়হায় মাতম করে আর চোখের পানি ফেলে কিইবা হবে। যা হবার তাতো হয়েই গেছে। যে যাবার সেতো চলেই গেছে। এটাই সত্য, তাকে আর আমরা ফিরে পাবোনা। তবে শিক্ষা হলো – জোড়া জোড়া মন্ত্রী, ডজন ডজন নেতা, কোটি কোটি টাকা আর হামবড়া ভাব কিছুই আমাদের জন্য কোন কাজের নয়। এই বিপদে বাঁচার জন্য সামান্য অবলম্বনও সিলেটবাসীর নেই। নেই ছোট কেন বড় কারো জীবনের কোন গ্যারান্টি। তাই এই শিক্ষা এবং তার সাথে নিজের বিবেক আর সচেতনতাকে কাজে লাগাতে হবে। অন্তত এখন থেকে নিজের অধিকারের প্রতি অবিচার করা যাবেনা। প্লিজ, সরব হোন এবং বাঁচার মত বাচুন। কারণ, মরার মত বাঁচার কোন মূল্য নেই।

‌পরিশেষে বলবো, আসুন আগে আমরা নিজে বাঁচি এবং অন্যকেও বাঁচাই। ভুলেও যেন ঘর ঘেকে বের না হই, ব্যক্তি ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখি এ।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *