জামালগঞ্জে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ নাম মাত্র মাটি ফেলে দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা

জামালগঞ্জ প্রতিনিধি:: জামালগঞ্জে গুরুত্বহীন ঢিমেতালে এগুচ্ছে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারসহ বিপজ্জনক ভাঙ্গাগুলোতে নামমাত্র মাটি ফেলে দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে । তবে হাতেগোনা ১০-১২টি বাঁধ ছাড়া প্রায় সব বাঁধেই কোন ধরনের মাটি ফেলা হয়নি। এসব বাঁধে কাজের গতি দুর্বা ঘাস সরানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকছে। আবার কোনো বাঁধে মাটি ফেলা দূরের কথা আগাছা সরাতেও লাগানো হয়নি কোন কোদাল। শনি, হালি ও মহালিয়া হাওর ঘুরে এমন উৎকণ্ঠিত বাস্তবতাই পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে পাগনায় কাজের গতি কিছুটা ভালো বলে জানা গেছে।

শনি হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লালুর গোয়ালা ক্লোজারে গিয়ে দেখা যায়, এর এক পাড়ে কোনো রকম মাটি ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। শনির বিপদ কাটাতে একই ক্লোজারে দেওয়া হয়েছে দ্বিগুণ বরাদ্দ। দুই পিআইসিতে বিভক্ত করে এতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা। ওই একটি ক্লোজারে অধিক বরাদ্দ এবং দুই পিআইসিকে দায়িত্ব দেওয়ার পরও কাজে কোনো সন্তোষজনক অগ্রগতি নেই। যেখানে ১৫-২০ দিন আগে পুঁতা হয়েছিল বাঁশ। প্রায় তিন সপ্তাহ পরে এসেও এর কাজে গতি আনতে ব্যর্থ হয়েছে স্কিম কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে যেমন হতাশা বাড়ছে তেমনি একই জায়গায় দুই বরাদ্দ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছেন স্থানীয় কৃষক।

এ ব্যাপারে উপজেলা কাবিটা স্কীম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির শাখা কর্মকর্তা মো. রেজাউল কবির জানিয়েছেন,‘৬০ প্লাস ৬০ সমান ১২০ মিটার হওয়ায় এখানে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। কারণ এক প্রকল্পে আমাদের সর্বোচ্চ বরাদ্দ ২৫ লাখ। এই ক্লোজারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই ২৫ লাখে হবে না বিধায় দুই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’

শনি হাওরের আরেক ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার ৪নং পিআইসি ঝালোকালিতে কাজের দিক বিবেচনায় একই অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। এর এক অংশে আংশিক মাটি ফেলা হয়েছে। তবে ক্লোজারে কাউকে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে হালির হাওরের গুরুত্বপূর্ণ (৪৯নং পিআইসি) ডাকাতকালি বাঁধে এখন পর্যন্ত কোন মাটি ফেলা হয়নি। সদ্যই বাঁধে মাটি ফেলা হবে এমন আলামতও চোখে পড়েনি।

এছাড়া হালির অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ কালীবাড়ি বাঁধের কাজ চলছে ঢিমেতালে। প্রায় ১৫ দিন আগে এ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে এসকেভেটর মেশিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাঁধের পিআইসি সভাপতি মহিবুর রহমানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন, দোয়া পড়িয়ে আজই কাজ শুরু করা হবে। কিন্তু সে অনুযায়ী এখন পর্যন্ত কালীবাড়ি বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কেবল বাঁধের এক অংশে আংশিক মাটি ফেলা হয়েছে। এটি কখন শেষ হবে তা নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে কালিবাড়ি বাঁধের পরবর্তী ৫২নং পিআইসির মাটি ফেলার কাজ শেষ হলেও শুরু হয়নি তার পার্শ্ববর্তী ৫১নং পিআইসির কাজ।

অপরদিকে বৌলাই নদীর তীরবর্তী হালির আরেক বিপজ্জনক ক্লোজার (৬০নং পিআইসি) অধিক বরাদ্দের বিতর্কিত মদনাকান্দি পাথাইড়া ভাঙ্গায় বেশ আগে বাঁশ পুঁতা হলেও এখন পর্যন্ত মাটি ভরাট শেষ হয়নি। ভাঙ্গার অপর অংশে কিছু মাটি ফেলা হয়েছে। ভাঙ্গা ব্যতীত পুরো বাঁধে ফেলা হয়নি কোন মাটি। দেখা যায়নি বাঁধ কাজে সম্পৃক্ত সংশ্লিষ্টজনকে। কাজের এই ধীরগতি দেখে চরম শঙ্কায় রয়েছেন হালি পারের সাধারণ মানুষ। তবে সংশ্লিষ্টরা দ্রুত কাজে হাত দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।

এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মদনাকান্দি গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন,‘দেখছেন তো বান্ধে কি হইতাছে। যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হইছে এরা এই কাজডারে কোন কাজই মনে করতাছে না। আউল-ফাউল মানুষরে ধইরা পিআইসি বানানো হইছে। কাজ এখন কি কইরা হইব। কিন্তু এর জন্য তো কোন ব্যবস্থাও নেওয়া হইতাছে না।’

এছাড়া জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর দুই উপজেলায় বিস্তৃত মহালিয়া হাওরের জামালগঞ্জ অংশের ৫টি বাঁধের মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে মাত্র (১৩নং পিআইসি) একটি বাঁধে। মহালিয়ার ১৪নং পিআইসির বিপজ্জনক ভাঙ্গাটিতে শুধু কয়েকটি বাঁশ পুঁতে রাখা হয়েছে। এ ভাঙ্গাসহ হিজলা গ্রামের নিকটবর্তী মহালিয়ার অন্য বাঁধে কোন কাজই শুরু হয়নি। নির্দেশিকা বোর্ড ব্যতীত সংশ্লিষ্ট কাউকে বাঁধে দেখা যায়নি। এমন অবস্থা প্রায় বেশকিছু বাঁধে লক্ষ্য করা গেছে।

১৪নং পিআইসির ভাঙ্গা পাড়ে অবস্থান করা পার্শ্ববর্তী সুলাইমানপুর গ্রামের মো. সবুজ মিয়া জানিয়েছেন,‘এই বাঁশগুলো আজ পুঁতা হয়েছে। এর আগে আর কোন কাজ হয়নি এখানে।’

১৩নং পিআইসির কাজ দেখভালো করা (পিআইসি রূপন তালুকদারের ছোট ভাই) মদনকান্দি গ্রামের রিপন তালুকদার বলেন, ‘গাড়ি আসতেছে, কালকের মধ্যে কাজ শুরু হইয়া যাইব। হিজলা বান্ধের কাজও আরম্ব হইব।’
হিজলা গ্রামের রামানন্দ বর্মণ বলেছেন, ‘কাজ এখনও শুরু হইছে না। চেষ্টা করতাছে, ভেকু পাইতাছে না। যার লাগি দেরী হইতাছে।’

জামালগঞ্জে হাওর রক্ষা বাঁধ কাজে দুর্নীতি হচ্ছে এমন অভিযোগ এনে গত ২৮ জানুয়ারি সুনামগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি দ্বীজেন্দ্র লাল দাশের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন সংবাদ সম্মেলন করেন। তার প্রেক্ষিতে পরদিন ২৯ জানুয়ারি জামালগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা পালের পক্ষ নিয়ে কৃষক ও পিআইসি ব্যানারে সাংবাদিক সম্মেলন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ। এতে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে এবং ৫০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু শনি, হালি ও মহালিয়া হাওর ঘুরে এসে বাস্তবে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। সর্বসাকুল্যে ৩০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলেও মনে হয় না। তবে পাগনা হাওরের কাজে কিছুটা স্বস্তির খবর পাওয়া গেছে।

উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ জানিয়েছেন,‘বাঁধের কাজে উপজেলার সার্বিক পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। তবে পাগনার পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো। এ হাওরের ২২টি বাঁধের মধ্যে ৮টিতে মাটি ফেলার কাজ প্রায় শেষ। বাকি কয়টিতে অর্ধেক, কোনটিতে ভেকু নেই, কোনটিতে আসতেছে এমন অবস্থা। অনেক পিআইসি বাঁধে নেই। এর জন্য কোন জবাবদিহিতা থাকছে না। যার জন্য গতিহীন হয়ে পড়েছে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ।’

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও প্রিয়াংকা পাল বলেন,‘প্রতিদিনই আমাদের লোক মাঠে যাচ্ছে। আগামীকাল হালি ও শনির হাওরে যারা কাজ ধরতে ব্যর্থ হবে তাদেরকে হয় বাতিল করব না হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *