আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) গত বৃহস্পতিবারের আদেশ ছিল মিয়ানমারের জন্য একটি বড় তিরস্কার, কিন্তু তা খুব একটা কাজে আসবে না। ‘বিশ্ব আদালত’ আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার বোঝে কি বোঝে না তা নির্ভর করছে ওই ‘বিশ্ব আদালত’কে আপনারা কিভাবে ব্যাখ্যা করছেন তার ওপর। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের আচরণের ব্যাপারে আদেশ দেওয়ার মাধ্যমে আইসিজে নিশ্চিত করেছেন, তাত্ত্বিকভাবে তাঁরা ন্যায়বিচার পরিচালনায় পারদর্শী। তবে বাস্তবে হয়তো ততটা নয়।
জাতিসংঘের বিচারসংক্রান্ত শাখা আইসিজেকে বলা হয়েছিল সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আইনি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে মামলার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়া দাবি করেছে, ১৯৫১ সালের জেনোসাইড সনদ লঙ্ঘন করে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) ১৯৫৬ সালে জেনোসাইড সনদ অনুমোদন করে।
গত ডিসেম্বর মাসে আদালত উভয় পক্ষের আইনি যুক্তি-তর্ক শুনেছেন। সে সময় শিরোনাম হয়েছিলেন মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারপ্রধান ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি। গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার বিষয়ে আদালত চারটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। প্রথমত, জেনোসাইড সনদের আওতায় হত্যা ও গুরুতর শারীরিক ক্ষতিসহ সব অপরাধ প্রতিরোধে মিয়ানমার সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। ‘ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিক ক্ষতিসাধনের জন্য একটি গোষ্ঠীর ওপর দুর্ভোগ চাপিয়ে দেওয়া’ ও ‘একটি গোষ্ঠীর মধ্যে জন্ম প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া’—এ ধরনের নারকীয় ঘটনা ঠেকাতেও আদালত রায় দিয়েছেন। অন্যান্য ব্যবস্থা হিসেবে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সামরিক বাহিনীর ওপর ‘নিয়ন্ত্রণ, নির্দেশনা ও প্রভাব’ খাটাতে ও রোহিঙ্গা নিপীড়ন সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রথমে চার মাসের মধ্যে এবং পরবর্তীতে ছয় মাস পর পর আদালতের কাছে মিয়ানমারকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
রাখাইনসহ মিয়ানমারের অন্যত্র ক্রমশ অবনতিশীল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অস্ট্রেলীয় আইনজ্ঞ জেমস ক্রফিল্ডসহ (আইসিজের বিচারক) আইসিজের প্রচেষ্টা ইতিহাসে ম্লান হয়ে যাবে। মিয়ানমার সরকার ইতিমধ্যে নিশ্চিতভাবেই অভ্যন্তরীণভাবে নিজের দোষ ঢাকার জন্য প্রচারণা শুরু করেছে। আইসিজের আদেশের প্রাক্কালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার তার নিজস্ব স্বাধীন তদন্ত কমিশনের ফলাফল সম্পর্কিত বিবৃতি প্রচার করে। ঘরে বসে ও গোপনে পরিচালিত ওই তদন্তের ফলাফলে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু জেনোসাইড হয়নি। মিয়ানমারের নিজস্ব স্বাধীন তদন্ত কমিশনের ওই ফলাফল নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এ ক্ষেত্রে মূল পার্থক্যটি হলো, যুদ্ধাপরাধের দায় ব্যক্তির। অন্যদিকে জেনোসাইডের দায় সরকারের নীতির। কথিত যুদ্ধাপরাধের জন্য মিয়ানমারে কারো বিচার হবে, এমন সম্ভাবনাও নেই। মিয়ানমারের বাইরে ওই বিবৃতিকে ‘সত্য লুকানোর চেষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করে নিন্দা জানানো হয়েছে।
মিয়ানমারের নিজস্ব তদন্ত কমিশন অন্য যে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে তা হলো, মিয়ানমার সরকার অভ্যন্তরীণভাবে নিজের অবস্থান সুরক্ষিত করতে আগ্রহী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টির সত্যিকারের কোনো আগ্রহ নেই।
চীনের সঙ্গে স্বল্প সময়ের জন্য দূরত্ব সৃষ্টি হলে অবরোধ শিথিলের জন্য মিয়ানমারের নেতারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেছেন এবং ওবামা প্রশাসন ও বাকি বিশ্বের সঙ্গে খেলেছেন। তবে এখন চীন আবারও মাঠে ফিরে এসেছে। এখন মিয়ানমারের আর বিশ্বকে দরকার নেই।
আমি আগেই বলেছিলাম যে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে সু চির সম্ভবত কখনো মাথাব্যথা ছিল না। সম্ভবত তিনি বিশেষ করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও আর অবস্থান নিতে চান না। এটি হয়তো এখন তাঁর ‘পারিবারিক বিষয়।’
মিয়ানমারের ভেতর আইসিজেকে একরকম অশুভ শক্তি হিসেবে দেখা হয়, যারা মিয়ানমারের মূল্যবান সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করছে। গত ডিসেম্বরে আইসিজেতে সু চির উপস্থিতি, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন এবং জেনোসাইড সংঘটিত হয়নি বলে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর ব্যাপক সমালোচনা হলেও দেশে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ২০০১ সালের পর প্রথম কোনো চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে শি চিনপিংয়ের এ মাসেই মিয়ানমার সফর কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। দুই দেশের মধ্যে ৩৩টি চুক্তি সই এবং নেতাদের মুখে জোরালো ‘পারিবারিক’ ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের স্তুতি থেকে যে কেউ শুনতে পারেন, ভূরাজনীতির চাকায় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার পিষ্ট হচ্ছে।
চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে গলায় গলায় সম্পর্কের অন্যতম মূল বিষয় হলো কিয়াউকফু বন্দর উন্নয়ন। এটি সেই রাখাইন রাজ্যের উপকূলে অবস্থিত, যেখানে রোহিঙ্গারা নিপীড়িত হয়েছে। মূল প্রস্তাবে আছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও এ সম্পর্কিত অবকাঠামো উন্নয়ন। এর উদ্দেশ্য আন্দামান সাগরের শুয়ে গ্যাসক্ষেত্রের সঙ্গে চীন-মিয়ানমার গ্যাস পাইপলাইনকে সংযুক্ত করা। কিয়াউকফু থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত ওই পাইপলাইন প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’ মহাপরিকল্পনার বড় উপকরণ কিয়াউকফু। এটি চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ও তাঁর দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে একবার সাক্ষাতের সময় তাঁরা আমাকে রাখাইন রাজ্যে প্রস্তাবিত উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি মানচিত্র দেখিয়েছিলেন। মানচিত্রের সেই কাগজ এত পুরনো ছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল, পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সবাই সেটি দেখেছে। সেদিন আমি অনুভব করেছিলাম, রোহিঙ্গারাও ভূরাজনীতির নিশানা ভালোভাবে বুঝতে শিখেছে।
রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করাই ছিল বন্দর, গ্যাস পাইপলাইন ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবচেয়ে সহজ উপায়। এর অর্থ হলো, মিয়ানমার সরকার উন্নয়নের সুবিধা ও চাকরিবাকরি মূলত বৌদ্ধ বার্মার লোকদের জন্য নিশ্চিত করতে পারবে এবং সমস্যা সৃষ্টিকারী, অসহযোগী ও মুসলমান রোহিঙ্গাদের এর ভাগ দিতে হবে না।
কিয়াউকফু বন্দর ও অন্যান্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পের আকার ও মূল্য নিশ্চিতভাবেই রোহিঙ্গা সংকটে চীনকে মিয়ানমারের পাশে থাকার নিশ্চয়তা দেবে। আইসিজে তাঁর রায় না মানলে বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঠাতে পারবেন। কিন্তু সেখানে নিশ্চিতভাবেই চীন ‘ভেটো’ দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে হত্যা করবে।
আইসিজে গত বৃহস্পতিবার যখন আদেশ দিচ্ছিলেন তখন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা পুরনো রেডিও, মোবাইল ফোন ও টেলিভিশনকে ঘিরে সেটি জানার চেষ্টার করছিল। এই আদেশ তাদের জীবনে সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন আনবে না। তারা এখনো অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে বসবাস করছে। তারা এখনো নিপীড়িত। তারা এখনো নিজেদের দেশে ফিরতে নিরাপদ বোধ করে না। তাদের জন্য আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের দূরত্ব অনেক। প্রতিদিনই তারা এটি বুঝতে পারছে।
লেখক : মিয়ানমার, জিম্বাবুয়ে ও পশ্চিম সাহারায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাবিষয়ক বৈশ্বিক গণমাধ্যম উপদেষ্টা এবং জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বিষয়ক উপদেষ্টা, সাংবাদিক ও গবেষক।
(অস্ট্রেলিয়ার নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লোয়ি ইনস্টিটিউটের প্রকাশনা দি ইন্টারপ্রেটারে প্রকাশিত নিবন্ধ ভাষান্তর করেছেন মেহেদী হাসান)