সিলেট-আখাউড়া রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ ১৭৯ কিলোমিটারে ১৩ ‘ডেড স্টপ’

সিলেট নিউজ টাইমস্ ডেস্ক
সিলেট-আখাউড়া রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। জরাজীর্ণ হয়ে পড়া এ সেকশনে রয়েছে ১৩টি মহাঝুঁকিপূর্ণ সেতু, রেলওয়ের ভাষায় যা ‘ডেড স্টপ’। এছাড়া ট্রেনলাইনও ত্রুটিপূর্ণ। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে এ রেলপথে। গত পাঁচ মাসেই ঘটেছে অন্তত ১১টি দুর্ঘটনা। এতে বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের।

ঘন ঘন দুর্ঘটনার কারণে এ সেকশনে ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক থাকছে না। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে আগে ট্রেন চলত ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন তা অর্ধেকে, অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

পাঁচ বছর আগে রেলওয়ের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন আহসান হাবীব। ছয় মাস ধরে তিনি রেলওয়ের সিলেট স্টেশনে সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, পাহাড়ি ও আঁকাবাঁকা সড়ক হওয়ায় আখাউড়া-সিলেট সেকশনের রশিদপুর থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তথ্যমতে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রামে যাতায়াত করে।

সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের মোগলাবাজার থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জায়গায় স্লিপারের নাটবল্টু খুলে গেছে। আবার কোথাও কোথাও নাটবল্টু ঢিলা থাকায় রেললাইন নড়বড়ে হয়ে আছে। রেলের দুই স্লিপারের মাঝে পর্যাপ্ত পাথরও নেই।

এ সেকশনের সেতুগুলোর অবস্থা আরো নাজুক। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, নির্মাণের ৫০-৫৫ বছর পরই সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অথচ এ রুটের ৯০ শতাংশ সেতুর বয়সই ৭০ বছর পেরিয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ১৩টি স্পটকে ডেড স্টপ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আটটি ও মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি সেতু ডেড স্টপ হিসেবে চিহ্নিত।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন ম্যানেজার সজীব কুমার মালাকার বলেন, ডেড স্টপ হিসেবে চিহ্নিত করা সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, পরে পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে।

রেলওয়ের প্রকৌশল শাখা জানায়, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের অতিঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে শমশেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯ নম্বর সেতু ও মনতলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। এ সেতুগুলো সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এখনই এগুলো সংস্কারের সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

পাঁচ মাসে ১১ দুর্ঘটনা: গত পাঁচ মাসে সিলেট-আখাউড়া রেললাইনে ১১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ৪ অক্টোবর সকালে আখাউড়ায় জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় ২ ঘণ্টা বন্ধ ছিল চট্টগ্রামের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ।

এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর সকালে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয়। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় একই ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়। একটি বগির চারটি চাকা লাইন থেকে সরে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

মাইজগাঁও স্টেশনমাস্টার সাখাওয়াত হোসেন রেললাইনের সমস্যার কারণে এ স্থানে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানালেও রেলওয়ের প্রকৌশল শাখার একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ট্রেনের পুরনো ইঞ্জিন ও বগির কারণেও এ দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে জালালাবাদ ট্রেনের বগি সবচেয়ে পুরনো হওয়ায় এ ট্রেন বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

গত ১৬ আগস্ট ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁওয়ে যাত্রীবাহী উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার শিকার হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ ট্রেনের একটি বগির চারটি চাকা লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে ১৫-২০ যাত্রী আহত হয়।

গত ১৯ ও ২০ জুলাই কুলাউড়া জংশন এলাকায় দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯ জুলাই সকালে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের একটি বগি কুলাউড়ায় লাইনচ্যুত হয়। এতে কয়েকজন যাত্রী আহত হয়। পরদিন ২০ জুলাই সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া ঢাকাগামী আন্তঃনগর কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই স্থানে দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে সারা দেশের সঙ্গে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ আড়াই ঘণ্টা বন্ধ থাকে।

গত ৭ জুলাই ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস কুলাউড়ার হাজিপুরের পলকি ও মনু ব্রিজের মাঝখানে একটি গরুকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলে গরুটি মারা যায়। এতে ইঞ্জিনের সামনের একটি হোস পাইপ ভেঙে ঘটনাস্থলে ট্রেনটি থেমে যায়। বিকল হয়ে যায় ইঞ্জিন।

গত ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয় ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস। ব্রিজ থেকে ট্রেনের পাঁচটি বগি ছড়ায় পড়ে পাঁচজন নিহত ও ৬৭ জনের মতো আহত হয়। ২১ ঘণ্টা পর রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়। এছাড়া গত ২ জুন হবিগঞ্জের বাহুবলের রশিদপুরে কুশিয়ারা ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এতে সারা দেশের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ ১৬ ঘণ্টা বন্ধ ছিল।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *