ওসমানী মেডিকেলে এক অসহায় লাশের ছেলের করুণ আর্তনাদ!

সাহেদ আহমদ:: সিলেট ওসমানী মেডিকেলে পোস্টমর্টম ছাড়া বাবার লাশ দাফন করতে চায় ছেলে!
এক্সিডেন্টে নিহত লাশের ছেলে তারেক এর ফেইসবুক স্টেটাস থেকে নেওয়া, আমার বাবার লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন করতে চাই।

জানি আমার এই পোস্ট অনেকেই এড়িয়ে যাবেন। আমি ও হয়তো অন্য কারো পোস্ট হইলে এড়িয়ে যাইতাম। দীর্ঘ ১৯ দিন পর নানা নির্যাতন সহ্য করে আব্বা ইন্তেকাল করেন। ১৯ দিন হয়তো খুব ই কম সময় অনেকের কাছেই। আমার কাছে ও ১৯ দিন বেশি সময় না। আমার বয়স এখন ১৯। খেলতে খেলতে বয়স ১৯ হয়ে গেল। পৃথিবীর কোন নিষ্ঠুরতাই বুঝতে পারি নাই ১৯ দিন আগে। আমি এখন হিমাগারের পাশের বারান্ধায় বসে এই লিখা লিখছি।আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। না এখন ৩ জন আব্বা সহ ৪ জন ছিলাম। এখন আমি আম্মা আর আমার ছোট ভাই। আমাদের পরিবার সুখি ই ছিল। আব্বা নতুন বাজারে ব্যবসা করতেন। আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। ছোট ভাই কলেজে ভর্তি হইছে। যাক। এগুলো কেন বলছি আমি নিজে ও জানি না। গত ১০ সেপ্টেম্বর হটাত আব্বার মোবাইল এ একটি কল আসে। আমার ফুফুজি খুব অসুস্থ। ফুফুজিকে নিয়ে হবিগঞ্জ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া লাগবে। আব্বা খবর শুনেই দৌড়। প্রায় ১ ঘণ্টা পর আম্মা আব্বার মোবাইল এ কল করেন। অপর পাশ থেকে অপিরিচিত একজন বলেন, আব্বাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। আমি ঘরে ছিলাম না। আম্মা কান্না শুনে কষ্ট করে বুঝতে পারি আব্বা এক্সিডেন্ট করছেন। এর পরের ১৯ দিন আমার কাছে ভয়ঙ্কর ১৯ বছরের ফুলসিরাত। আমি শুনে কিভাবে যে হবিগঞ্জ যাই নিজে ই জানি না। গিয়ে দেখি আব্বার রক্ত মাখা বডি হাসপাতালের বারান্ধায় ফালান। সারা মাথা ফেটে চৌচির। মেজের চার পাশে রক্তের বন্যা। আমি জীবনে ও এত রক্ত দেখি নাই। কোন একজন ডাক্তার, নার্স আমার আব্বার পাশে ও আসে নাই। আমি যাওয়ার পর, আমার কিছু বন্ধু, আত্মীয় সজন ও আসেন। তারা বলে কয়ে কোনরকমে মাথায় একটি বেন্দিজ করে সিলেট রওয়ানা হই। আমার এক খালাত ভাই ডাক্তার হওয়ায় তার সাথে যোগাযোগ করে উসমানী হাসপাতালে দিনে দিনে অপারেশন সম্ভব না। তাই সিদ্ধান্ত করে প্রাইভেট একটি হাসপাতালে অপারেশন করা হয়।

এই সময় জানতে পারি আব্বার মাথার আঘাত খুব মারাত্মক। আব্বাদের সি এন জি আর ইমা (লেগুনা)গাড়ির মুখুমুখি সংঘর্ষ হয়। অপারেশন এর পর আব্বাকে আই সি ইউ তে রাখা হয়। তিন দিন রাখার পর অপারেশন আর আই সি ইউ এর খরচ মিলিয়ে বেশ অনেক টাকা বিল হয়। পরে এত টাকা ব্যয় ভার বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তাই উসমানী হাসপাতালের আই সি ইউ তে নিয়ে আসি। কম খরচের আশায়। আসার পর বুঝতে পারি। আশায় গুড়েবালি। প্রথম ভর্তি হওয়ার আগে ই ১২০০০ টাকার অসুধের লিস্ট। প্রতি দিন ১২০০০ থেকে ২০০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেশি বিদেশি অসুধ, ইনজেকশন, টেস্ট আর টেস্ট। প্রতি ঘণ্টায়। আই সি ইউ ইউনিট এর সামনে ২৪ ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকা লাগে, কখন জানি বিকট শব্দে ডাক দেয় আই সি ইউ ফোর। আর হাতে ধরিয়ে দেয় এক চিরকুট। কি রাত কি দিন, রাত ২-৩ টায় ও অসুধ এনে দিছি। হাসপাতালের নার্সরা আমাদের কে মানুষ ই মনে করে না। আয়াদের রাজত্ব। প্রতিদিন ২০০ টাকা তাদের কে দেয়া লাগছে, নাইলে তারা রুগির পাশে ই যায় না। এই ভাবে ই বিগত ১৯ দিন কাটাই। এক্সিডেন্ট এর বেশ কিছু দিন পর আমার ফুফাত ভাই বলেন, থানায় একটি এন্ট্রি করে রাখার জন্য।

এবং বলছেন এক্সিডেন্ট এর সাথে সাথে নাকি উনি থানায় জানাইছেন। থানা থেকে কেউ কোন পাত্তা দেয় নাই। হাসপাতালে ভর্তি করার সময় জিজ্ঞেস করছে কিভাবে আহত হইছেন। আমরা বলছি এক্সিডেন্ট করে। তাই তারা নাকি লিখে রাখছে পুলিশ কেস। আজ বিকেল ৫.১৫ আব্বা ইন্তেকাল করছেন, এখন রাত ২ টা। হাসপাতাল বলছে থানা থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আনার জন্য। আমার ফুফাত ভাই সন্ধ্যা থেকে জানাইছেন নিয়ে আসতেছি, নিয়ে আসতেছি, আব্বার লাশ নিয়ে আমি আর আমার আম্মার প্রতিটা সেকেন্ডই এক একটা দিন লাগছে। রাত ১০ টার দিকে ফুফাত ভাই ফোন দিয়ে বলেন, থানা থেকে ক্লিয়ারেন্স দেয় না। মামলা নাকি হইছে এখন ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন করা যাবে না।মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমন কি আমাদের এম পি সাব ও নাকি কল করে থানার ওসি সাব কে বলছেন। কোন কাজ হয় নাই, আমার আব্বার লাশ কে কাঁটা ছিঁড়া করে দিল- কলিজা খুলতে দিতে আমি আমার আম্মা ও আমার ভাই আমরা কেউ ই চাই না। আমি ও আমরা আমার আব্বার মরার জন্য কাউ কে দায়ী করব না, এই ১৯ দিনে আমি বুঝে গেছি পৃথিবীটা কেমন, মানুষের প্রতি, পুলিশের প্রতি, ডাক্তার নার্সের প্রতি আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।

আমি কোন মামলা করতে চাই না। আমার মাকে নিয়ে বাচতে চাই। আমি কোর্ট কাছারিতে যেতে চাই না। আমি শুধু আমার আব্বাকে কাঁটা ছিঁড়া ছাড়া দাফন করতে চাই। কেউ কি আমাকে এই সাহায্যটুকু করতে পারবেন ???? কেউ একজন।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *