৯ দফা দাবির কী পেল শিক্ষার্থীরা

বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ৯ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ছয় দিন ধরে রাস্তায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও শিক্ষার্থীদের এসব দাবির ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি সামনে এনেছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি দীর্ঘদিন ফাইলচাপা পড়ে ছিল।সরকারের নীতিনির্ধারকরাও বলছেন, শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসায় সড়ক ঘিরে দীর্ঘদিনের জঞ্জাল ও আবর্জনা দূর হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।রাস্তায় নামলেই নিত্যদিনের দুর্ভোগ আর ভোগান্তি যেন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল।তাই অহিংস পন্থায় শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে শুরু থেকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় সরকারও।নেতা বা সাংগঠনিক ভিত্তি ছাড়া দাবি আদায়ের এমন জোরালো পদক্ষেপ অতীতে খুব কম দেখা গেছে।কিন্তু ধীরে ধীরে রাজপথের কর্মসূচি সহিংস মাত্রায় পৌঁছার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।বাস ভাংচুর, আগুন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলার মধ্য দিয়ে এরই মধ্যে তার কিছু আলামতও মিলেছে।আবার কোথাও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে।তাই সংশ্নিষ্টরা বলছেন,সরকারকে দাবি মানার শর্ত দিয়ে হলেও জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাজপথ ছেড়ে যাওয়া উচিত।

সংশ্নিষ্টরা আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এরই মধ্যে সরকার ১৫টি পদক্ষেপ নিয়েছে।তা হলো- শহীদ রমিজ উদ্দীন কলেজকে পাঁচটি বাস বরাদ্দ, স্কুল-সংলগ্ন বিমানবন্দর সড়কে আন্ডারপাস নির্মাণ, দেশের সব স্কুল সংলগ্ন সড়কে গতিরোধক নির্মাণ, স্কুলের পাশে বিশেষ ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ, নিহত দিয়া খানম মীম ও আবদুল করিম রাজীবের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে প্রদান, সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে নতুন সড়ক পরিবহন আইন, দ্রুত মামলা শেষ করার বিধান রেখে আইন সংশোধন, জাবালে নূরের দুটি বাসের রুট পারমিট বাতিল ও ফিটনেসবিহীন সব বাসের রুট পারমিট বাতিলের উদ্যোগ, লাইসেন্সবিহীন ভুয়া চালকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ, নৌপরিবহন মন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া, গাড়ির মালিককে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া,এ মামলায় আরও চারজনকে গ্রেফতার করা, জাবালে নূরের চালককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়া ও মহাসড়কে বিশ্রামাগার তৈরির ব্যবস্থা নেওয়া।শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বাস আজ সকালে হস্তান্তর করা হবে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, শিক্ষার্থীদের যে দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে তা শুক্র ও শনিবারের মধ্যে হয়তো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে আগামীকাল রোববার থেকেই যেন আমরা দেখতে পাই- সেই কাজগুলোয় নীতিনির্ধারকরা হাত দিয়েছেন।এ ছাড়া সরকারকে দাবি মানার পদক্ষেপ নেওয়ার শর্ত দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানান তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আমরা বিভিন্নভাবে এরই মধ্যে বলেছি, সরকার শিক্ষার্থীদের কোনো দাবির সঙ্গে দ্বিমত করেনি।সব দাবি পূরণ করা হবে।অনেক দাবি এরই মধ্যে পূরণও হয়েছে।ওভারপাস নির্মাণসহ কিছু দাবি রয়েছে যা রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।এর জন্য পরিকল্পনা হাতে নিতে হয়। তা শুরু হয়েছে।দাবি পূরণের পরও রাস্তায় থাকা যৌক্তিক নয়।

পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, শিক্ষার্থীদের সব দাবি সরকার মেনে নিয়েছে।এখন তারা রাস্তায় থাকলে দুর্ভোগ বাড়বে।গণমাধ্যমসহ সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।ছাত্রছাত্রীদের ভুল বুঝিয়ে বা তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে কেউ যাতে আইন অমান্য করতে না পারে,সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে।

র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, এখন তাদের ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করব।কারণ এখন যেটা আশঙ্কার বিষয়,আন্দোলনকারীদের মধ্যে স্বার্থান্বেষী মহল ঢুকে পড়েছে।ছাত্রছাত্রীদের কারও মুখ থেকে এমন সব অশ্নীল শব্দ বের করানো হচ্ছে,যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।এমন পরিস্থিতিতে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় থাকলে তাদের নিরাপত্তা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।তাই অভিভাবক, শিক্ষক ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্যসহ সবাইকে অনুরোধ করব- সন্তানদের এখনই রাস্তা থেকে সরিয়ে নিন।

শিক্ষার্থীরা তাদের স্লোগান, ফেস্টুন, ব্যানার ও ফেসবুকের মাধ্যমে যে ৯ দফা দিয়েছে তার মধ্যে এক নম্বর দাবি ছিল- জাবালে নূরের সেই ঘাতক চালককে ফাঁসি দিতে হবে।এ ছাড়া ফাঁসির শাস্তি আইনে যুক্ত করতে হবে।এক নম্বর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে বাসচালক মাসুম বিল্লাহ ও তার সহকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।গ্রেফতার করা হয়েছে বাস মালিককেও।চালককে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।আইনমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন, দ্রুত এ মামলার বিচার সম্পন্ন করবে সরকার।এ ছাড়া মামলায় দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সঙ্গে অপরাধজনিত হত্যার ধারা সংযোজন করা হয়েছে।আগামী সোমবার এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনা মন্ত্রিপরিষদে তোলা হবে। সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নে প্রস্তাবনাটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল। দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় চলমান বিক্ষোভের পর এ বিষয়টিতে গতি এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে নতুন আইন শিগগিরই সংসদে উপস্থাপন করা হবে।

শিক্ষার্থীদের দুই নম্বর দাবি ছিল দুর্ঘটনার পর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ভারতের দুর্ঘটনার উদাহরণ দিয়ে হাসতে হাসতে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া।এরই মধ্যে নৌপরিবহনমন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছেন।মীমদের মহাখালীর দক্ষিণপাড়ার বাসায় গিয়ে তিনি তার হাসির ব্যাখ্যা দেন ও ক্ষমা চান। তবে আন্দোলন চলাকালে রাস্তায় কেউ কেউ মন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান দিয়েছে।তবে শাজাহান খান বলেছেন, শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগ চায়নি।বিএনপি তার পদত্যাগ দাবি করেছে।

আন্দোলনকারীদের তিন নম্বর দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে চলাচলে বিকল্প ব্যবস্থা করা।এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ঘটনাস্থলে ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস নির্মাণে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন।এ ছাড়া শহীদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজকে ৫টি বাস দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।এ ব্যাপারে গতকাল শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একটি নকশা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।তবে রাতারাতি কোনো ওভারপাস ও ফুটওভার ব্রিজ তৈরি সম্ভব নয়।

শিক্ষার্থীদের চার নম্বর দাবি হলো- প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার নির্মাণ করা।এরই মধ্যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে স্পিডব্রেকার নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকার বলছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন সড়ক থাকলে সেখানে ট্রাফিক পুলিশ রাখা হবে।

৫ নম্বর দাবি ছিল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।এরই মধ্যে নিহত দু’জনের পরিবারকে ২০ লাখ করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।এ ছাড়া আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার।

ছয় নম্বর দাবি ছিল- শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে।এরই মধ্যে ট্রাফিক পুলিশকে এ নির্দেশনা মানতে বলা হয়েছে।

সাত নম্বর দাবি হলো- শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা।একসময় ঢাকায় প্রায় সব পরিবহনে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিচয়পত্র দেখালে হাফ ভাড়া দিয়ে চলাচল করতে পারত। এখন দু-একটি বাস ছাড়া কোনো যানবাহনে হাফ ভাড়া নেওয়া হয় না।এ দাবির ব্যাপারে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।সরকার এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কাজও শুরু করেছে।

আট নম্বর দাবি ছিল- রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং লাইসেন্স ছাড়া চালকদের গাড়ি চালনা বন্ধ করতে হবে।সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে লাইসেন্সবিহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।সরকারি প্রতিষ্ঠানের যানবাহন চালকদের লাইসেন্স সঙ্গে রাখতে বলা হয়।যাদের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাদের দ্রুত নবায়ন করার ব্যাপারে নির্দেশ এসেছে।

৯ নম্বর দাবি ছিল- বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বাসে অতিরিক্ত যাত্রী ও যততত্র লোক ওঠানোর ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে।কারণ পাল্লা দিয়ে যততত্র জায়গায় যাত্রী তুলতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *