সুনামগঞ্জের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ ৪৩ কোটি টাকা পিআইসি’র পেটে!

নিজস্ব প্রতিনিধি:: হাওরের ফসলরক্ষায় নির্মিত ৯৬৪টি বাঁধ এখন বর্ষার জলে ধসে হাওরে মিশে যাচ্ছে। বাঁধ টেকসই করার জন্য প্রথম বারের মতো চলতি বছর সরকার কমপেকশন করে (দুর্মুজকরণ) বন ও ঘাস লাগানোর জন্য ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু দুর্মুজ না করে ঘাস না লাগানোয় এখন বাঁধগুলো সহজেই ধসে হাওরে মিশে যাচ্ছে। কতগুলো বাঁধে কমপেকশন করা হয়েছে এবং কি পরিমাণ ঘাস ও বন লাগানো হয়েছে তার পরিসংখ্যান জানা নেই জেলা কমিটির সদস্য সচিবের কাছে। প্রতিটি উপজেলায় চিঠি দিয়েও তিনি এই তথ্য পাননি।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থ বছরে হাওরের ফসলরক্ষার জন্য সরকার ১৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। বাঁধ নির্মাণে ৯৬৪টি প্রকল্প গ্রহণ করে ৭৭৩ কি.মি. বাঁধ নির্মিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই তৃতীয়াংশ বিলও দেওয়া হয়ে গেছে। সর্বশেষ বিলের বরাদ্দও ইতোমধ্যে ছাড় দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, জেলার ৫২টি হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের জন্য সরকার প্রতিটি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সভাপতি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারিদের সদস্যসচিব করে উপজেলা কমিটি গঠন করেছিল। উপজেলা থেকে প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে আলাদা পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন হয়েছিল। নীতিমালা অনুসারে প্রতিটি বাঁধে দুর্মুজ করে বন বা ঘাস লাগানোর জন্য সরকার প্রথম বারের মতো বিশাল বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু বন বা ঘাস না লাগিয়েই পিআইসি’র লোকজন ইতোমধ্যে দুই তৃতীয়াংশ বিল তুলে নিয়েছেন। প্রতি বর্গমিটারে ঘাস লাগানোর জন্য সরকার ২৬ টাকা করে আলাদাভাবে মোট ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। আলাদা বরাদ্দ কোন কাজে না লাগায় সহজেই বর্ষার পানি বাঁধ ধসিয়ে নিচ্ছে।

বিশাল বরাদ্দ দিলেও নীতিমালা মেনে যথাসময়ে বাঁধের কাজ করেনি পিআইসি এমন অভিযোগ আছে। কাজের শুরুতে নীতিমালা অনুযায়ী কমপেকশন ও বাঁধের দুই দিকে বন বা ঘাস না লাগানোয় টেকসই হয়নি বাঁধগুলো, দুর্মুজও করা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্যসচিব মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া গত ১ মার্চ প্রতি উপজেলা প্রকল্প কমিটিকে পত্র দিয়ে বাঁধে কমপেকশন করা বা ঘাস লাগানো হচ্ছেনা বলে লিখিতভাবে অবগত করেছিলেন। কিন্তু তার এই আবেদন উপেক্ষা করেই ঘাস না লাগিয়ে মাস্টার রোল জমা দেয় পিআইসিগুলো। প্রাক্কলন অনুযায়ী ঘাস না লাগানোয় সংশ্লিষ্টরা এ থেকে ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে বেশিরভাগই ‘ফাউ’ হিসেবে বিল তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন অবশিষ্টগুলো তুলে নিতে তদবির করা হচ্ছে। জানা গেছে শেষ বিল প্রদানের অর্থও ইতোমধ্যে ছাড় দেওয়া হয়েছে।

হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ জানান, ৯৬৪ প্রকল্পের মধ্যে অধিকাংশ প্রকল্পেরই বাঁধে ঘাস লাগানো হয়নি। যে কারণে প্রতিটি হাওরের বাঁধ এখন বর্ষার জলে ধসে হাওরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কাজ শুরুর পরপরই দুর্মুজ করে ঘাস লাগানোর জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছিল সংগঠনটি।

ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চন্দ্রসোনারথাল হাওরের বাঁধে কোন ঘাস ও বন লাগানো হয়নি। এখন বাঁধটি হাওরে ধসে মিশে যাচ্ছে। একই হাওরের কাটাখালি বাঁধেও ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ ছিল। পিআইসি সভাপতি মঞ্জুর আলী বাঁধে বন বা ঘাস লাগাননি, দুর্মুজও করেননি। সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের ধানকুনিয়া হাওরের উত্তর নূরপুর বাঁধে ২৫ লক্ষ, একই হাওরের মোহনপুরের বাঁধে ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কোনটাতেই ঘাস বা বন লাগানো হয়নি। ঘাস না লাগানোয় এখন বর্ষার পানিতে বাঁধগুলো ধসে হাওরে মিশে যাচ্ছে।

ধানকুনিয়া হাওরের উত্তর নূরপুর বাঁধের পিআইসি সভাপতি রফিকুল বারী চৌধুরী বাচ্চু বলেন, আমরা প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ করেছি। এখন হাওরের উত্তাল ঢেউ বাঁধগুলো ভেঙে দিচ্ছে। স্থায়ী বাঁধ না হলে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। তাছাড়া চোরাই জেলেরা বাঁধ কেটে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, এবার ৯৬৪টি বাঁধে ৪৩ কোটি টাকা ঘাস লাগানোর জন্য দেওয়া হয়েছিল মূলত বাঁধ টেকসই করার জন্য। কিন্তু কোন বাঁধেই ঘাস লাগানো হয়নি, দুর্মুজও হয়নি। এতবড় বরাদ্দ কাজ না করেই কিভাবে উত্তোলন হলো বা এর বিল কিভাবে সমন্বয় করা হলো সেটা বড় রহস্যের। বাঁধে ঘাস লাগালে এখন এই বর্ষায় এত সহজে বাঁধগুলো ধসে যেতনা বলে জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া বলেন, কাজের শেষদিকে আমি বাঁধগুলো ঘুরে দেখেছি। অধিকাংশ বাঁধেই ঘাস লাগানো হয়নি।

পরে সংশ্লিষ্ট পিআইসিকে নীতিমালা মনে করিয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। তাদের কেউ চিঠির জবাব ওই সময়ে দেননি। তাই উপজেলা কমিটিগুলো কিভাবে এই বরাদ্দের বিল সমন্বয় করছে আমার জানা নেই।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *