বাংলাদেশে এসে আম খেতে চেয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার শততম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে আজ ১৮ জুলাই। এই দিনটিকে নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে এসেছিলেন। খবর বিবিসি বাংলার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নোবেলজয়ী ম্যান্ডেলাসহ ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ফিলিস্তিন আর তুরস্কের দুই নেতার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ২৫ মার্চ সকালে বাংলাদেশে আসেন।

তিনদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি ঢাকায় তখনকার হোটেল শেরাটনে (এখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) উঠেছিলেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির তখন ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। তিনি ম্যান্ডেলার সঙ্গে তার হোটেল রুমে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

তিনি বলছেন, নেলসন ম্যান্ডেলা জানতেন যে, আমি আসছি। তার কক্ষে প্রবেশের পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এর আগে বিদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার মুক্তির পক্ষে আমি অনেক কথা বলেছিলাম। সেগুলো স্মরণ করে তিনি আমাকে একজন বন্ধু বলে সম্বোধন করেন। তিনি আমাকে তার একটি ছবি উপহার দেন, যেখানে লেখা ছিল, ‘মোহাম্মদ জমির, বেস্ট উইশেস টু আ ডিপেন্ডেবল ফ্রেন্ড।’

হোটেল রুমে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক বিষয় নিয়ে মোহাম্মদ জমিরের সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার কথা হয়। জমির বলেন, আলাপে তিনি অনেক গুরুত্ব দিলেন। তার একটি হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। তিনি বললেন, দরিদ্র যারা আছে, তারা শুধু আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ভুগছে না, তাদের শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে হবে। আরও বলেন, যারা নিপীড়িত, তাদের সহযোগিতা দিতে হবে, যাতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

রাষ্ট্রদূত হিসেবে কীভাবে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করা যায়, তা নিয়েও মোহাম্মদ জমিরকে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৭১ সালের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম নিয়ে কিছু করা হচ্ছে কিনা, সেসব জানতে চেয়েছিলেন ম্যান্ডেলা।

পরদিন ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন ও স্বাধীনতার স্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ম্যান্ডেলা। তার আগে অপর দুই নেতার সঙ্গে সাভারে স্মৃতিসৌধে পুষ্প অর্পণ করেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া বক্তব্যে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকান মানুষের সংগ্রামের বর্ণনা তুলে ধরে বাংলাদেশ ও তাদের রাজনৈতিক, বাণিজ্য আর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেন।

হাজার হাজার মানুষের সেই সমাবেশে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, স্বাধীনতা আর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের অনেক মিল রয়েছে। আজ আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, বাংলাদেশের মানুষকেও একসময় এরকম সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। একটি দূরের দেশ হওয়ার সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের মুক্তি সংগ্রামে আপনারা যে সমর্থন দিয়েছেন, সেজন্য আপনাদের প্রতি আমি তাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।

নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন ফকির আলমগীর। ফকির আলমগীর বলেন, সেই গানের কথা জানতে পেরে তার সঙ্গে নিজে থেকেই দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ম্যান্ডেলা। সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোন পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করে সেই গান শুনিয়েছিলেন আলমগীর।

ফকির আলমগীর বলেন, তখনকার প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে টেলিফোন করে হোটেল শেরাটনে আসতে বলেন। আমার স্ত্রীকেও নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কারণ বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে (প্রেসিডেন্টের নিমন্ত্রণে) নিজের হোটেল কক্ষে নেলসন ম্যান্ডেলা আমার সঙ্গে দেখা করবে।

তিনি বলেন, তখন দ্রুত ছুটে গেলাম শেরাটনে। অনেকেই দেখা করবে বলে লবিতে অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমাকে সরাসরি তার রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি তখন বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন এবং নেমেই তিনি আমাকে বললেন, গানটা গাও। আমি যখন গানটা ধরেছি, তিনি আমার সঙ্গে আফ্রিকান স্টাইলে নাচতে শুরু করলেন, সেটা এখনও আমার চোখে লেগে আছে।

এসব গানের কথা আগেই তাকে জানানো হয়েছিল বলে ফকির আলমগীর জানান। এরপর তার গাড়ি বহরের সঙ্গেই বঙ্গভবনে যান ফকির আলমগীর। সেখানে ঢুকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অতিথি কক্ষে যাওয়ার আগে তার দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানান নেলসন ম্যান্ডেলা।

যদিও খাবারের ক্ষেত্রে পরিমিত ছিলেন ম্যান্ডেলা। তবে কূটনৈতিক কর্মকর্তা মোহাম্মেদ জমিরের সঙ্গে অনেক আলাপের মধ্যে আমের প্রসঙ্গও তুলেছিলেন। তিনি বলেন, আলাপচারিতার মধ্যে আমাকে একটি প্রশ্ন করলেন যে, আমি শুনেছি আপনি আমের কথা বলেছিলেন এক জায়গায়। তো কই, আম কই? আমি বললাম, এখন তো মার্চ মাস, এখন আম হবে না। আপনি যদি মে মাসে বা জুন মাসে আসেন, তাহলে আম খাওয়াতে পারি। তখন উনি খুব হাসলেন। আবার বললেন, তাহলে এ মাসে আর আম পাওয়া যাবে না?

২৭ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে ফিরে যান ম্যান্ডেলা। সেটাই ছিল বাংলাদেশে তার প্রথম এবং শেষ সফর। এরপর আর তার বাংলাদেশে আসা হয়নি। নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তার মৃত্যুতে বাংলাদেশেও তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছিল।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *