সিলেটে শুরু, সিলেটেই শেষ?

নিউজ ডেস্ক:: জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও পৌর নির্বাচন কিংবা হোক আইনজীবী, শিক্ষক বা অন্য কোনা পেশাজীবী পরিষদের ভোট সব জায়গায় জোটবদ্ধভাবে লড়ে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। জামায়াতে ইসলামী বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম দল। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন হারালেও নির্বাচনের হিসাব-নিকাশে বিএনপির এখনো ‘ভোট বন্ধু’ জামায়াতে ইসলামী। তবে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সেই হিসাব মেলাতে পারছে না দল দুটি।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে একসঙ্গে নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে জোটবদ্ধ হয় দুদল। এরপর এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জোটবদ্ধ রয়েছে তারা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগত অংশ নেয় বিএনপি-জামায়াত। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি কোনো দলই।

সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জোটের প্রার্থী হিসেবে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে লড়ছেন আরিফুল হক চৌধুরী। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম ‘বাস’ প্রতীকে জোটের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রচারণায় নেমেছেন। এ কারণে তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী দিয়েছে জামায়াত। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ‘টেবিল ঘড়ি’ প্রতীকে লড়ছেন জামায়াতের এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন স্থগিত করায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।

সিলেটে মেয়র পদে প্রার্থিতা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের দীর্ঘদিনের সম্পর্কে চিড় ধরতে দেখা যাচ্ছে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগেই উভয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামায়াতের ঘোরবিরোধী হিসেবে পরিচিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে জোটের ভেতরে কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত একাধিকবার আলোচনায় উঠে আসলেও, কি অদৃশ্য কারণে থমকে যায় তা বোধগম্য নয়। তবে এতটুকু বলতে পারি, জামায়াতকে জোটে রাখা না রাখার সিদ্ধান্ত আমাদের (স্থায়ী কমিটির) ওপরে না, এটা নির্ভর করছে জোট প্রধান স্বয়ং খালেদা জিয়া ওপর।’

২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত জোটবদ্ধ হয় পুণ্যভূমি সিলেট থেকেই। অথচ এখন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক মহলে আলোচনায় উঠে আসছে, তাহলে কি সিলেট থেকে শুরু হয়ে সিলেটেই শেষ হতে যাচ্ছে জামায়াত-বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের পথচলা? যদিও জোটের ১০ জুলাই বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ঐক্য এখনও অটুট রয়েছে। আমরা আশাবাদী জামায়াত ইসলামী বিএনপির মনোনীত মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকেই সমর্থন জানাবে। জোটের পক্ষ থেকে জামায়াত ইসলামীকে অনুরোধও করা হয়েছে।’

মেয়র মনোনয়ন নিয়ে জোট নেতারা এ পর্যন্ত দুটি বৈঠক করেছেন। ১৪ জুলাইয়ের আগের জোট বৈঠকে জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য আব্দুল হালিম বলেন, ‘আমি দলের সর্বোচ্চ নেতা নই। দলে আমারও মুরুব্বি আছে, তাদের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।’

অবশ্য ১৪ জুলাইয়ের বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মপরিষদের অপর সদস্য মোবারক হোসেন অংশ নেন। তিনিও একই সুরে বলেন, ‘আমি দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।’

এ ঘটনায় জোটের বৈঠকে নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও নজরুল ইসলাম খানকে বিব্রত হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।

বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভাষ্য, ‘আওয়ামী লীগকে পাস আর বিএনপিকে বাঁশ’ মিশনে জামায়াত তাদের প্রার্থিতা নিয়ে সিলেটে অবিচল। জোটপ্রধান খালেদা জিয়া জেলে থাকা অবস্থায় নির্বাচনে থাকা জামায়াতের কৌশলী পথচলা নাকি সরকারের সঙ্গে আঁতাত, তা নিয়েও সন্দেহ করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

কেন্দ্রীয় জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য, সিলেট মহানগরীর আমির মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘আমি এখনও জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছি। ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের কিছু বাধার মুখেও নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। গতকালও আমার একটি পথসভা ছিল যা সন্ত্রাসীরা পণ্ড করে দিয়েছে। যাদের নামে মামলা রয়েছে পুলিশ প্রশাসন জামায়াতের সেই সব নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় অভিযান চালাচ্ছে। যদিও আমরা প্রায় সবাই জামিনে রয়েছি। আমি এসব বিষয়ে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছি। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জামায়াতের নতুন করে হারানোর কিছু নেই। জোটে থাকলেই কি?…বরং এই নির্বাচন হবে জামায়াতের জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন জানান দেওয়ার নির্বাচন।’

এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াত সমর্থিত এই প্রার্থী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাত করার সুযোগ নেই। এই ধরনের প্রশ্ন করাটাই অবান্তর। জামায়াত অন্য কারো সিদ্ধান্তে চলে না, নিজেদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বরং নির্বাচনী কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে চালিয়ে যেতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা রয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জোট গঠনের আগে সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গাঁ-ঝাড়া দিয়েছিল জামায়াত। এরপর রাজপথে বিএনপির সঙ্গে গড়ে তোলে সখ্যতা। একই সঙ্গে নামকরণ ঘটনা, ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় পীর বুজুর্গসহ সর্বস্তরের আলেম-উলামার সমর্থন পায় বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে নামকরণবিরোধী আন্দোলন। সরকারবিরোধী আন্দোলনও বেগবান হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্ব গঠিত হয় ৪ দলীয় জোট, যা এখন ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়েছে।

সিলেট থেকে বিএনপি-জামায়াত সর্ম্পক যে দৃঢ়তা পেয়েছিল, সেই সিলেট থেকেই সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। কারণ সিটি নির্বাচনে কোনোভাবেই বিএনপিকে ছাড় দিতে রাজি হয়নি জামায়াত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী মহানগর জামায়াতের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, ‘সরকার ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বৈরিতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। জোটপ্রধান খালেদা জিয়া নন, বিএনপির নীতিনির্ধারণী দুই/একজন নেতাদের ইশারায় জামায়াতকে সবকিছুতে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে। অথচ আন্দোলনে বিএনপির লোকজন রাজপথে না থাকাকালীন জামায়াতকে ব্যবহারও করেছে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে দূরত্ব ততই বাড়াচ্ছে। যা আমাদের (জামায়াত) কাছে ওপেন সিক্রেট।’

সিলেট সিটিতে জামায়াতের প্রার্থী প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোট শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি, সিলেট সিটি নির্বাচন থেকে জামায়াতের প্রার্থী প্রত্যাহারের ব্যাপারে পরশু দিনের জোট বৈঠক থেকে অনুরোধ করা হয়। তখন বৈঠকে অংশ নেওয়া কেন্দ্রীয় জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য মোবারক হোসেন জানান, প্রার্থী প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। তারা নির্বাচন করব, এটাই তাদের সিদ্ধান্ত।’

জামায়াত প্রশ্নে পাল্টে যেতে পারে কি বিএনপির জোটবদ্ধ নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ? এমন প্রশ্নে শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য গঠন বিএনপির একান্ত সিদ্ধান্ত। এলডিপি একটি পরীক্ষিত রাজনৈতিক দল। আমরা জাতীয় ঐক্য গঠনে চেষ্টা করছি না, বরং আমরা মনে করছি, জাতীয় ঐক্যের নামে রাম, সাম, যদু, মধুকে না টেনে বিএনপির অবহেলিত ও বঞ্চিত নেতাকর্মীদের সাংগঠনিকভাবে সংঘটিত করলেই বরং ভালো হতো। কারণ এই সুযোগে অর্বাচীন নেতারা এসে অনাকাঙ্ক্ষিত আসন দাবি করলে জাতীয় ঐক্য বিফলে যেতে পারে।’

কাগজে কলমে নির্দলীয় হলেও ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত অংশ নেয় সমঝোতা করেই। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা যায় ব্যতিক্রম। মেয়র বা কাউন্সিলর পদে সমর্থন দিয়ে এই জোট আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো বৈঠকই করেনি, এমনকি যোগাযোগও হয়নি। ভোটের দিন বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা রয়ে যায় লড়াইয়ে এবং চট্টগ্রামে দলটির একাধিক প্রার্থী জিতেছেনও নির্বাচনে।

বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, খালেদা জিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ এবং পরে টানা হরতাল ডাকলেও সেই কর্মসূচির পক্ষে সেভাবে কাজ করেনি জামায়াত কর্মীরা। দলটির সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও মাঠে নামানো যায়নি কর্মীদের। অথচ আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা বৈঠক বা আলোচনা গত এক দশকে আটকে গেছে জামায়াত ইস্যুতে। জামায়াত জোটে থাকলে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা নয়, আওয়ামী লীগের এই দাবি শুরুতে গুরুত্ব না দিলেও এখন সেই বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে দলের ভেতর।

জোটের একাধিক সূত্রের দাবি, অনেক রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সমমনা সংগঠন রয়েছে যারা বিএনপির সঙ্গে সর্ম্পক উন্নয়নে আগ্রহী। কিন্তু জামায়াতের কারণে তারা দূরে। বিএনপি সরে দাঁড়ালে, তারা (জামায়াত) একঘরে হয়ে যাবে। কারণ বিএনপির পাশে থেকে দেশের রাজনীতিতে নিজদের অস্তিত্ব ছড়িয়ে দিয়েছে জামায়াত। তাই চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপির জন্য জামায়াতের কোনো দরকার নেই, তারা (জামায়াত) সবসময় স্বার্থপর। জামায়াত জোটগত রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে নিজেদের দলীয় স্বার্থ রক্ষায় যে মরিয়া সিলেটের সিটি নির্বাচনে তাদের প্রার্থিতাই প্রমাণ বলেও দাবি সেই সূত্রের।

এ ছাড়াও বেশ কিছুদিন পূর্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ছাত্রদলের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের মধ্যে এ বিষয়ে হওয়া এক ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়। ফোনালাপে মওদুদ ও আবেদ দুজনকেই বলতে শোনা যায়, জামায়াতের সঙ্গে জোটে থাকা বিএনপির জন্য আর লাভজনক নয় কোনোভাবেই। বরং তাদেরকে জোট থেকে বের করে দিলে স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি মিলবে বিএনপির। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর আস্থাও অর্জন করা যাবে। তবে এ নিয়ে দল কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় হতাশার কথা জানিয়েছেন দুই নেতাই।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *