জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস তদবিরবাজদের দৌরাত্ম্য

নিউজ ডেস্ক:: তদবিরবাজদের বহুমুখি চাপে পাঁচদিন আত্মগোপনে ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পঞ্চানন বালা। গত ২০ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত তিনি অফিসে না এসে মোবাইল ফোন বন্ধ করে চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ৫০৩ জনের পদায়ন সম্পন্ন করেছেন। পদায়নের নোটিস টাঙানোর পর তিনি আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে গত সোমবার অফিস করেছেন।

গতকাল মঙ্গলবারও তিনি অফিস করেছেন। তবে পছন্দের স্কুলে পদায়ন না পাওয়ায় বঞ্চিতরা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। বেনামে বঞ্চিত একাধিক শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বরাবরে অভিযোগ করেছেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও বিভিন্ন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার সারাদেশের ন্যায় সুনামগঞ্জ জেলার ৫০৩ জন সহকারি শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে গত মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করে।

প্রজ্ঞাপনে এক সপ্তাহের মধ্যে তাদেরকে পদায়নের নির্দেশনা দিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের পত্র দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপন জারির পরই জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে বহুমুখি তদবির আসতে থাকে। সিন্ডিকেট করে শিক্ষক নেতারাও চাপ দিতে থাকেন। এই অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েন সংশ্লিষ্টরা। ফলে গত ২০ জুন থেকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পঞ্চানন বালা মোবাইল ফোন বন্ধ করে অফিসে না এসে জেলা শহরেই নিরাপদে থেকে প্রতিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের সহায়তায় দ্রুত সময়ে পদায়নের তালিকা তৈরি করেন। নীতিমালা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা ও নিকটবর্তী এলাকায় সংশ্লিষ্টদের নিয়োগদানের চেষ্টা করেন। তবে আত্মগোপনের সময়ে তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তদবিরবাজদের দাপট ও দৌরাত্ম্যের কারণে অন্যত্র নিরাপদে বসে নিয়োগের কাজ সম্পন্ন করছেন বলে অবগত করেন। তাই শিক্ষা অফিসে এসে তদবিরবাজরা হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এই ৫দিনে শিক্ষা অফিসার চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষকের পদায়নের বিষয়টি সম্পন্ন করে গত সোমবার বিকেলে নোটিস টাঙিয়ে দেন। পরে তিনি অফিসে অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ করেন।

জানা গেছে, জেলা শিক্ষা অফিসারের আত্মগোপনের সময়ে পদায়িত শিক্ষক ও অভিভাবকরা বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে পদবঞ্চিত শিক্ষকরা সিলেট প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক তাহমিনা খাতুনের কাছে বেনামে একাধিক অভিযোগ করেন। এই অভিযোগে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনেন তারা। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপপরিচালক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে বিষয়টি অবগত করেছেন। অন্যদিকে পদায়নের নোটিসের পর কাক্সিক্ষত স্কুল না পেয়ে শিক্ষক ও তাদের অভিভাবকরা জেলা শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ের সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এর বিদ্যালয়-২ শাখার উপ সচিব মনোয়ারা ইশরাত স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে সারাদেশের সহকরি শিক্ষকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়নের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এই তালিকায় সুনামগঞ্জের ৫০৩ জন সহকারি শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদে চলতি দায়িত্ব প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

গত ২৫ জুন সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সুনামগঞ্জের ৫০৩ শিক্ষকের চলতি দায়িত্বের স্কুলগুলোর নামোল্লেখ করে তালিকা প্রকাশ করে। গতকাল মঙ্গলবার পদায়িত প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষক সংশ্লিষ্ট স্কুলে যোগদান করেছেন। পছন্দের স্কুল না পেয়ে কিছু শিক্ষক এখনো যোগদান করেননি। তারা নানাভাবে এখনো তদবির করছেন বলে জানা গেছে।
পছন্দের পদায়ন বঞ্চিত শিক্ষকরা গোপনে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদায়নের কাজ সম্পন্ন করায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। বঞ্চিতরা নীতিমালা লঙ্ঘন হয়েছে এমন অভিযোগও আনেন।

জামালগঞ্জের পূর্ব লম্বাবাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলতি দায়িত্বের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মালাঘোষ চৌধুরী বলেন, আমি কোন তদবির বা অনিয়মের সুযোগ নেইনি। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নীতিমালার আলোকে আমার কাছের এলাকার স্কুলে দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে যারা বঞ্চিত হয়েছেন তারা ক্ষুব্ধ হয়ে নানা কথা বলছেন। তিনি বলেন, আমার জানা মতে এই নিয়োগ শতভাগ ফেয়ার হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পছন্দের পদায়ন বঞ্চিত এক শিক্ষক বলেন, আমার কাছে কৌশলে পছন্দের স্কুলে পদায়নের জন্য ঘুষ চাওয়া হয়েছিল। আমি দেইনি বলে আমাকে পছন্দের স্কুলে দেওয়া হয়নি।
সদর উপজেলা সহকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সোলেমান মিয়া বলেন, চলতি দায়িত্বের শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়নের বিষয়ে ডিপিইও স্যার আমাদেরকে উপজেলায় কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমরা সম্পূর্ণ নীতিমালা মেনে কাজ করেছি। স্যারও তদবিরের চাপে মোবাইল বন্ধ করে অফিসে না এসে যথাসময়ে শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ কাজ শেষ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার আমাদের শিক্ষকদের ৯০ ভাগ দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পঞ্চানন বালা বলেন, আমি নানামুখি তদবিরের চাপ এড়িয়ে জেলা শহরে থেকেই শতভাগ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এবং নীতিমালা মেনে পদায়নের কাজ সম্পন্ন করেছি। মোবাইল ফোন বন্ধ রাখলেও অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম সার্বক্ষণিক। স্বচ্ছতার কারণে আমি কোন শিক্ষক, তদবিরকারী এবং অফিসের কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি। যারা পছন্দের স্কুলে পদায়নের সুযোগ পায়নি তারাই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনছে। তাছাড়া আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ দুর্নীতি করলে আমি প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় উপ-পরিচালক তাহমিনা সুলতানা বলেন, গত ৫দিন ধরে সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের ফোন বন্ধ ছিল। আমাদের সঙ্গে সে কোন যোগাযোগ করেনি। চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষকদের পদায়ন বিষয়ে সে কোন আলাপও করেনি। আমার কাছে বেনামে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ আসার পর আমি মহাপরিচালককে এসব বিষয়ে লিখিত জানিয়েছি।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *