নিউজ ডেস্ক:: সম্প্রতি কক্সবাজারে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি একরামুল হক একরাম। নিহত হওয়ার পর থেকে, বিশেষত একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ পত্রপত্রিকায় নানামুখী আলোচনা চলছে। এর মাঝে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে। ২০১৪ সালে ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির তালাশ-এ প্রচারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দরিদ্র হিসেবে আলোচিত কাউন্সিলর একরামের সম্পদের যে বিবরণ পাওয়া যায় তা হচ্ছে: টেকনাফে একটি বাড়ি ও একটি নির্মাণাধীন বাড়ি। চট্টগ্রামে একটি বাড়ি, ঢাকার ধানমন্ডিতে ৩০০০ স্কয়ার ফুটের একটি ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল গাড়ি ও হোন্ডা। কিছুদিন পর পর হোন্ডার মডেল পরিবর্তন করা ছিল তার অন্যতম শখ।
২০১০ থেকে গত মাস পর্যন্ত যতবার দেশের মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য প্রচারিত হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই ছিল একরামের নাম। ২০১০ সালে নির্বাচন কমিশনে প্রদত্ত আয়ব্যয়ের বিবরণীতে একরামের আয় দেখানো হয়েছিল মাসে ১৬ হাজার টাকা, নগদ জমা ৩৩ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে তিন লক্ষ টাকা। আয়কর বিবরণী অনুসারে টেকনাফ শাখার ইসলামী ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকে জমা ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা, স্ত্রীর নামে ৭ কোটি টাকা ও দুই মেয়ের নামে চার কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। এছাড়াও জমি ও সম্পদের মূল্য দেখানো হয়েছে ১৯ কোটি টাকা। আয়ের উৎস দেখানো হয়েছে জমি বিক্রি ও পরিবহন ব্যবসা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কোন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে এত দ্রুত তিনি কোটিপতি বনে গেলেন!
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উৎস শুধুই ইয়াবা। গত মাসে একরামের ১৬ লাখ ইয়াবার চালান নিয়ে টেকনাফ জুড়ে আলোচনার সূত্রপাত হয় যা কালের কণ্ঠসহ বেশ কয়েকটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশে দশ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ একরামের জন্য অর্থ উপার্জনের খাত হিসেবে দেখা দেয়। রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে ইয়াবা পাচার, তিনটি স্পটে রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে ইয়াবার আসর বসানো ছাড়াও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার বানানো ও আদম ব্যবসার কমিশন এজেন্ট হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। মাদক ব্যবসা ছাড়াও রোহিঙ্গা বান্ধব হিসেবে সরকারের কালো তালিকাভুক্ত ৫১ জনের সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন একরাম। এ সিন্ডিকেটের সাথে তিনটি উগ্রপন্থি সংগঠন ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমঝোতা ছিল। কথিত আছে যে, টেকনাফ কেন্দ্রিক এই সিন্ডিকেটকে আস্থায় নিয়েই মায়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করেছিল এবং বিনিময়ে মায়ানমার সীমান্তে অবাধে ইয়াবা চালানের টোকেন প্রদান করে। একরামুল হক ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সাহেদুর রহমান নিপু ও মোহাম্মদ ফয়সালের সবচেয়ে আস্থাভাজন ব্যক্তি।
উল্লেখ্য নিপু স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদির ছেলে এবং ফয়সাল এজহার কোম্পানির ছেলে তথা সাংসদ বদির ভাই। প্রতিদ্বন্দ্বি ব্যবসায়ীদের উপর চাপ সৃষ্টি এবং মাদক বিরোধী কার্যক্রম রুখে দিতে বদির অন্যতম প্রধান পেশীশক্তি ছিল একরাম বাহিনী। তাদের হাত ধরে ২০০৭ সালে পুরোদমে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের তালিকায় উঠে আসে একরামের নাম। ইয়াবা ব্যবসায় একরামের মূল ভূমিকা ছিল মধ্যস্থাতাকারী হিসেবে। ক্রমে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয় একরাম। ইয়াবা ছাড়াও চোরাচালানের মাধ্যমে মায়ানমার থেকে আনা বিয়ার, মদসহ বিভিন্ন পণ্য সারাদেশে পৌঁছে দিতে তার নিয়ন্ত্রিত পরিবহন মোটা অংকের টাকা উপার্জন করতে করে। ২০১৫ সালে ইয়াবা গডফাদার মং মং সেন নিহত হওয়ার পর হুন্ডি ব্যবসা শুরু করে। এছাড়া চুক্তিতে বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা পৌঁছে দেয়ার কাজে পারদর্শি ছিলেন একরাম। একরামের অনুগত পাঁচ জন কর্তৃক পরিচালিত একরাম বাহিনী। ট্রাকের হেলপার থেকে চারটি ট্রাকের মালিক হওয়া মো: ইসমাইল, পিতা: জসিম উদ্দিন তার অন্যতম প্রধান সহযোগি। এছাড়া কেকেপাড়ার মো: শফিক, পিতা আবদুল হক, মো: সাব্বির আহমেদ সাবু, পিতা মিয়া হোসেন, মো: শওকত, পিতা লোকমান হাকিম এবং সৈয়দ আলম একরামের প্রধান সহযোগী। একরামের পরামর্শদাতা হিসেবে স্ত্রী আয়েশা বেগমের ভাই নজরুল ও কক্সবাজারের পৌর মেয়র মাহবুবের নাম জানা যায়। একরামের জনপ্রিয়তা ছিল এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ জনপ্রিয়তা সাংসদ বদিরও রয়েছে কিন্তু তারমানে এই নয় যে সে নিরপরাধ। তবে এ মুহূর্তে যে বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত তা হচ্ছে মাদক সম্রাজ্ঞী খ্যাত ছোট আম্মা রহস্য। জানা যায়, আয়েশা বেগম নামে দুজন মহিলা শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে আলোচিত। এ দুজনকে নিয়ে রয়েছে রহস্যও কারণ বোরখায় ঢাকা দুই নারী মুখ দেখান না। একজন আয়েশা বেগমকে বড় আম্মা এবং অপরজনকে ছোট আম্মা বলে কোড নামে ডাকা হয়। তাদের নামে বড় বড় চালান পার হয়ে যায় কিন্তু কেউ জানে না এদুজনের পেছনে কারা সহায়ক ভূমিকা রাখছেন, অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধেও কেউ দাঁড়ায় নি। একরাম ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণে প্রশ্ন উঠেছে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগমই কি ছোট আম্মা? আকরামের স্ত্রীর মাদক ব্যবসার সম্পৃক্ততা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে কারণ একরামের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সূত্রে জানা যায়, নিহত হওয়ার দিন দুপুরে একরামের অনুগত পাঁচ সহযোগীর চারজনকে বিশেষ কাজে টেকনাফ থেকে অন্য কোথাও পাঠিয়েছে আয়েশা।
একরামের মৃত্যুর একদিন পরই আয়েশা কয়েকজনকে একরামে পাওনা টাকা পরিশোধের অনুরোধ করছেন। টেকনাফ ও কক্সবাজারের মেয়র এ বিষয়ের মধ্যস্থতা করছে। আয়েশা বেগমই যদি সেই আলোচিত রহস্যময়ী ছোট মা হয়ে থাকেন তাহলে একরামের মাদক সাম্রাজ্য অটুট রয়েছে বলা যায়। গুঞ্জন চলছে যে, একরামকে গুলি করার অডিওটি পরিকল্পিতভাবেই মায়ানমারে ধারণ করা হয়েছে যা সম্পর্কে আয়েশা অবগত ছিলেন। ফোনে বলতে শোনা যায় একরাম টিএনওর কাছে যাচ্ছে। কিন্তু একরাম টিএনও অফিসে গিয়েছিলেন নিহত হওয়ার দিন দুপুরে। আরকটি সূত্র জানা যায়, একরামকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য র্যাব অফিসে ডাকা হলে তাকে হত্যা করা হবে এমন ধারণা থেকে ক্রসফায়ারের অডিও রেকর্ড করা হয়।