সিলেটে মাদক উদ্ধার অভিযানে গিয়ে দুই পুলিশ গুরুতর আহত, ১০ লাখ টাকায় ওসির মাধ্যম দফারফা

সিলেটে মাদক উদ্ধার অভিযানে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হলেও বিষয়টি প্রথমে গোপন রেখে ‘সাধারণ মাদকের মামলা’ করার নির্দেশ দেন কোতয়ালী থানার অপরাধ জগতের গডফাদার খ্যাত ওসি গৌছ । মাদক উদ্ধার ও পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার ঘটনা যাতে সংবাদ মাধ্যমসহ কেউ না জানতে পারে, সেজন্য আহত দুই পুলিশ সদস্যকে কোনো হাসপাতালে না রেখে ব্যারাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে ওসির নির্দেশে।

এমনকি ঘটনা রাত আড়াইটায় ঘটলেও মামলায় ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয় রাত সাড়ে ৪টা। অভিযোগ উঠেছে, কোতোয়ালি থানার ওসি এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মিলে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিষয়টি দফারফা করেছেন। যদিও তারা দু’জনই এটি অস্বীকার করেছেন।

২৭ মে নগরীর বন্দরবাজার এলাকার কাষ্টঘরের সুইপার কলোনিতে এ ঘটনা ঘটে। কলোনির পুরনো কোয়ার্টারের ২য় তলায় নওজোয়ান লালের কক্ষে ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে- এমন খবর পায় পুলিশ।

রাত ২টার পর কোতোয়ালি থানার এসআই (ডিউটি ইনচার্জ) মো. আকবর হোসাইন ভুঁইয়া, এসআই মো. ফায়াজ উদ্দিন ফয়েজ, এএসআই সঞ্জয় চন্দ্র দে, গোলাম রসুল, কনস্টেবল জীবন কর্মকার দে’সহ ১২ সদস্যের টিম সেখানে অভিযানে যায়।

অভিযানে ১০০ পিস ইয়াবাসহ জিয়া আরমান চৌধুরী ও ৫০ পিস ইয়াবাসহ ডালিম মিয়াকে আটক করে পুলিশ। জিয়া সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট (উত্তর মাহুতহাটি) গ্রামের মো. আলা উদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ও শহরতলির নয়াবাজারের আল ইসলাহ’র বাসিন্দা।

আর ডালিম সিলেট সদর উপজেলার রাজারগাঁওয়ের বাচ্চু মিয়ার ছেলে ও নগরীর শামীমাবাদের সেলিম মিয়ার কলোনির বাসিন্দা। এ সময় পরোয়ানাভুক্ত আসামি কাষ্টঘরের শংকর লালের ছেলে রুবেল লালকেও গ্রেফতার করা হয়।

জিয়া, ডালিম ও রুবেলকে থানায় নিয়ে আসার সময় সুইপার সরদার রাম বাবু ও আজগরের নেতৃত্বে মাদক ব্যবসায়ীরা বাধা দেয়। একপর্যায়ে মাদক ব্যবসায়ীরা ধাওয়া দিলে ডিউটি ইনর্চাজ এসআই আকবর, ফয়েজসহ পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে পালিয়ে যায়।

এ সময় মাদক ব্যবসায়ীদের ছোড়া ইটে মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান এএসআই সঞ্জয়। অজ্ঞান অবস্থায়ও সঞ্জয়কে মারধর করে মাদক ব্যবসায়ীরা। তাকে উদ্ধার করতে গেলে কনস্টেবল জীবনকে মাথায় বাঁশ ও রড দিয়ে আঘাত করে তারা।

রডের আঘাতে জীবনের ডান চোখের ওপরের অংশ ফেটে রক্ত বের হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে প্রথমে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগেই সঞ্জয় ও জীবনকে হাসপাতাল থেকে ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এ দুই পুলিশ সদস্য বর্তমানে ব্যারাকে চিকিৎসাধীন।

ওসমানী হাসপাতালের রেজিস্ট্রার সূত্র জানায়, ২৭ মে রাত ২টা ৪৫ মিনিটে এসএমপি কোতোয়ালি থানার ঠিকানা দিয়ে জীবন কর্মকার দে ও সঞ্জয় চন্দ্র দে নামের দু’জন রোগী ভর্তি হন। তারা হাসপাতালের ৪নং ওয়ার্ডের বেড নং- এক্সট্রা ১৬১’তে সঞ্জয় ও ১৬২’তে জীবন চিকিৎসা নেন। সঞ্জয়ের রেজি নং- ১৬১১০ ও জীবনের ১৬১০৯।

পরদিন তারা ওসি গৌছ এর নির্দেশে হাসপাতাল থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়।
সোমবার সকালে বিষয়টি সমাধানের জন্য ১০ লাখ টাকা নিয়ে থানায় ঘুরাঘুরি করে সুইপার সরদার রাম বাবু, আজগর, মাদক ব্যবসায়ী খোকন ও নওজোয়ান।

কোনো উপায় না পেয়ে তারা যায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে। মেয়র আরিফ তাদের কোনো প্রশ্রয় না দিয়ে কৌশলে বিষয়টি এরিয়ে যান। মেয়র বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সুইপার সরদার আমার কাছে ঘটনা বললে আমি তাদেরকে বলেছি তোমরা পুলিশকে মারধর করেছ, এত সাহস কই পাও? আমার কিছু করার নেই। বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বলেছি।

আরিফের কাছে আশ্রয় না পেয়ে তারা সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের কাছে যায়। কামরান বিষয়টি দেখে দেওয়ার জন্য এবং নিদোষ কাউকে হয়রানি না করার জন্য, কোতোয়ালি থানার ওসি গৌছুল হোসেনকে অনুরোধ করেন। ওসি সাবেক মেয়র কামরানের ফোনকলকে পুঁজি করে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে বিষয়টি দফারফা করেন।

পরে পুলিশ এসল্ট মামলা না করে ‘সাধারণ মাদক মামলা’ করা হয়। মামলায় দুই পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার কোনো বর্ণনাই নেই। এছাড়া ঘটনা রাত আড়াইটায় ঘটলেও মামলায় ঘটনার সময় রাত ৪টা ২০ মিনিট উল্লেখ করা হয়েছে।

সিলেট নিউজ টাইমস থেকে ওসি গৌছের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন । ওসি জানান ঐদিন রাত এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। পরে জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশিত খবর ও স্থানীয় অনেকগুলো অনলাইন পত্রিকার প্রকাশিত খবরের কথা ওসিকে বলার পর তিনি অন্যভাবে বুজানোর চেষ্টা করেন এবং মামলার কথা স্বীকার করেন।

এদিকে বুধবার রাতেই এসএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামেন। আহত দুই পুলিশ সদস্যকে ডেকে পাঠান। তাদের কাছে ঘটনার বিবরণ এবং তাদের শরীরের আঘাত দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।

সেই সঙ্গে অপরাধীদের নামে দ্রুত মামলা দায়েরের জন্য কোতোয়ালির ওসিকে নির্দেশ দেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে ঘটনার তিন দিন পর বুধবার রাতে পেনাল কোডের ১৪৩/৩৪১/৩৩২/৩৩৩/৩৫৩/১৮৬/১১৪ ও ৩৪ ধারায় মামলা রের্কড করেন ওসি গৌছুল।

তবে বুধবার গভীর রাতে দুপুরের সময় দিয়ে মামলাটি রেকর্ড করা হয়। মামলায় সুইপার সরদার আজগর ও মাদক ব্যবসায়ী নওজোয়ানকে প্রধান করে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়।

সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ১০ লাখ টাকার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ঘটনার দিন ফজরের নামাজের আগে সুইপাররা আমার কাছে এলে আমি কোতোয়ালি থানার ওসির সঙ্গে আলাপ করেছি মাত্র। যাতে নিরীহ কাউকে হয়রানি না করার জন্য। যারা ঘটনার সাথে জড়িত তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় নেওয়ার জন্য। সাবেক মেয়র কামরান আরো বলেন, দুই মাস পরে মেয়র নির্বাচন । এই নির্বাচনে আমি আওয়ামীলীগ থেকে নৌকা মার্কার প্রার্থী। আমার জনপ্রিয়তা ও জয় নিশ্চিত দেখে আমার বিরোধী পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন ঘটনায় উভয়পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিরীহ সুইপার ও দু’জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *