নিউজ ডেক্স:: দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে মঙ্গলবার হাত হারিয়েছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন। তিনি এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এর তিন দিন না যেতেই শুক্রবার বাসচাপায় মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে গৃহিণী আয়েশা খাতুনের। আর কখনোই দাঁড়াতে পারবেন না তিনি।
শুধু রাজীব বা আয়েশা নন, রাজধানীতে এভাবে প্রতিনিয়ত কাউকে না কাউকে বরণ করে নিতে হচ্ছে পঙ্গুত্ব, দুর্বিষহ জীবন। পরিবারকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে চলে যেতে হচ্ছে না ফেরার দেশে। আর তা ঘটছে বাস বেপরোয়া চালানোর কারণে। কিন্তু এসব দেখার সময় কোথায় চালকদের। গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যতই ঝড় উঠুক, যত প্রাণহানিই হোক- তিন দিন ধরে রাজধানীর ২০টিরও বেশি স্পট পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, চালকরা আগের মতোই বেপরোয়া।
দেখা গেছে, চালকদের রেষারেষি, কার আগে কে যাবে তা নিয়ে পাল্লা ও যাত্রী নেয়ার প্রতিযোগিতায় প্রতিদিনই অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। এতে গ্লাস ভেঙে, ধাক্কা খেয়ে বা চাপা পড়ে আহত হচ্ছেন অনেকেই। ওই সময়ে যাত্রীরা ভয়ে ও ব্যথায় চিৎকার করলেও চালকের মুখে হাসিই দেখা গেছে। বরং আর্তচিৎকার করায় যাত্রীদের ওপর বিরক্ত হন চালক। আর আইন লঙ্ঘনের এসব ঘটনা দেখার দায়িত্ব যাদের, বরাবরের মতোই তারা নির্বিকার- তাদের চেয়ে যে পরিবহন শ্রমিক-মালিকরাই শক্তিশালী!
শনিবার দুপুর। শাহবাগ মোড়ে সিগন্যাল ছাড়তেই একেক দিক থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কয়েকটি বাস। এর মধ্যে খাজাবাবা পরিবহন (ঢাকা মেট্রো-ব-১১৮৬৩৮) ও হিমাচল পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৮১৩৮) দুটি বাস এমনভাবে ঘষা খায় যাতে বেশ জোরে শব্দ হয়। অপেক্ষমাণ ও বাসের যাত্রীরা প্রাণভয়ে চিৎকার দেন। কিন্তু দুই বাসের চালক ও সহকারীদের মুখে হাসি।
কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারা মোড়ে এভারেস্ট পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-১১৩৮) একটি বাস সামনে থাকা একটি বাসকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এ সময়ও দুই চালককে হাসতে দেখা গেছে। ওই সময় শিখড় পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-জ-১১-১৪৯৪) ওই দুই বাসকে ওভারটেক করে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অথচ এসব বাস যেখানে দাঁড়ানো তার পাশেই লেখা ‘এখানে বাস দাঁড়ানো নিষেধ, দাঁড়ালেই দণ্ড’।
মতিঝিলে আরেকটি বাসকে ওভারটেক করে যাত্রী তুলছিল নিউভিশন পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-১৯৮৯)। কথা হয় এর চালকের সঙ্গে। নাম বলতে রাজি হলেন না তিনি। বললেন, ‘এভাবেই রাজধানীতে বাস চালাতে হয়। প্রতিযোগিতা ছাড়া এখানে টিকে থাকা যায় না। যত আগে যাওয়া যায়, ততই যাত্রী পাওয়া যায়।’ গাড়ির এমন অবস্থা কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অন্য বাসের সঙ্গে ঘষা লেগে এরকম হয়েছে। রং বা ঝালাই করে দেন না মালিক। মালিক জানেন, ওটা করে দিলে ২-৪ দিনের মধ্যে শেষ।’
ফার্মগেটে আবদুল্লাহপুর-ফুলবাড়িয়া সড়কে চলা বঙ্গবন্ধু পরিবহন স্পেশাল সার্ভিসের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-০৪৭২) যখন যাত্রী উঠছিল, ঠিক তখনই পেছন থেকে আর দুটি বাস এসে গাড়ির দরজা ঘেষে দাঁড়ায়। এ সময় যাত্রীরা ভয়ে দূরে সরে যান।
আবদুল্লাহপুর মোড়ে বঙ্গবন্ধু পরিবহনের একটি বাসকে (ঢাকা মেট্রো-ব-১২-০১৩৭) ধাক্কা দেয় বিআরটিসির একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৫৭১৮)। বিআরটিসির বাসটির সামনে-পেছনে ভাঙাচোরা। এর হেলপার হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বলেন, ‘আরে মিয়া রাখেন, বাসে উঠলে উঠেন, না উঠলে সইরা পড়েন’। সাংবাদিক পরিচয় দিলে হৃদয় বলেন, ‘বাসের তলায় কে পড়ে, কে মরে এসব দেখার সময় নেই। আমরা (চালক-সহকারী) টিভি-পত্রিকা পড়ি না।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালক জানান, ‘নাম বললেই গাড়ি হারাতে হবে। আমরা দৈনিক ভিত্তিতে গাড়ি চালাই। প্রতিদিন নির্ধারিত টাকা মালিককে দেয়ার পর বাকি টাকা আমাদের থাকে। ফলে যত ট্রিপ তত টাকা, যত দ্রুত গাড়ি চালানো যায়, ততই যাত্রী ওঠানো যায়। গাড়ি গাড়ি ঘষা কিংবা কোনো যাত্রী আহত-নিহত হলে আমাদের কিছু আসে যায় না। সবকিছু মালিক দেখেন।’
মানিকনগরে কথা হয় সিরাজুল ইসলাম নামের এক চালকের সঙ্গে। তিনি জানান, রেসিংয়ের মধ্যেই বাস চালাতে হচ্ছে। সিরিয়ালের গাড়ি হলেও একটি অপরটিকে পেছনে ফেলতে না পারলে অতিরিক্ত টাকা রোজগার করা যায় না। তাই একটি-আরেকটির সঙ্গে গা ঘেঁষে এমনভাবে চলে একটু এদিক-ওদিক হলেই দুর্ঘটনা ঘটে। পাল্লা দিয়ে চলতে গেলে অনেক সময় ধাক্কা খেয়ে কাচ ভেঙে আহত হন ভেতরের যাত্রী। তাছাড়া যাত্রী ওঠানামার সময় একটি গাড়ির আরেকটি গাড়িকে সাইড না দেয়ার ঘটনা তো হরহামেশা ঘটছে। এগুলোয় অবশ্য কারও কারও প্রাণ যায়, কেউ আহত হয়। কী করার আছে!’
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির আশীষ কুমার দে বলেন, এখনকার বাস্তবতায় পরিবহন মালিকরা প্রভাবশালী। শ্রমিকদের একটা বেপরোয়া মনোভাব আছে। তাদের কখনও বড় ধরনের কোনো প্রশিক্ষণের মুখোমুখি হতে হয়নি। সচেতনতাবোধ কম। দ্বিতীয়ত, এখন সড়ক পরিবহন সেক্টর পুরোপুরি রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। শ্রমিক নেতারা অনেক প্রভাবশালী। যে কারণে তাদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব গড়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, শ্রমিকদের মাঝে মজুরি অসন্তোষ আছে। তারা মালিকের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা পান না। যে কারণে বাড়তি কামাইয়ের জন্য বেপরোয়া গাড়ি চালান। তিনি বলেন, লক্ষাধিক চালকের জাল লাইসেন্স রয়েছে। তাদের কাউকে আইনের আওতায় আনা হয় না।
নিরাপদ সড়ক চাই কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বাস চালকরা কাউকেই মানছে না। এক প্রকার ফ্রি স্টাইলে গাড়ি চালাচ্ছে। চাকায় পিষ্ট হয়ে বা ধাক্কায় কে মরল, আহত হল তা দেখার সময় নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে চালকরা সবেচেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গত বছরের চেয়ে সাড়ে ২৮ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে। তিনি বলেন, আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একের পর এক যাত্রী প্রাণ হারালেও কয়টা চালকের শাস্তি হয়েছে- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ শনিবার সন্ধ্যায় জানান, রাজধানীতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বাস চলাচল করছে। এতে সাধারণ যাত্রীদের প্রাণ যাচ্ছে কিংবা গুরুতর আহত হচ্ছে। এমনটা আমরাও কখনও চাইনি, এর প্রতিবাদ আমরা সব সময় করছি। ঢাকায় এখন দক্ষ ও লাইসেন্সধারী চালকের খুবই অভাব রয়েছে। প্রায় সব চালকেরই চিন্তা-চেতনায় থাকে কার আগে কে যাবে। তাই এলোমেলোভাবেই তারা বাস চালাচ্ছে। তিনি বলেন, অধিকাংশ চালকই রোজভিত্তিক গাড়ি চালাচ্ছেন, তাতে চালকরা ব্যাকুল রোজগার বাড়াতে। বিআরটিএ ১৫ থেকে ১৬ লাখ লাইসেন্স দিয়েছে কিন্তু গাড়ি চলছে ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ। বুয়েটের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন যুগান্তরকে জানান, রাজধানীতে যেমন চালক-মালিকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে, তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকরাও তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। পুরো সড়ক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে দিন দিন এমন ভয়ংকর দুর্ঘটনা বাড়বে। তিনি বলেন, পুরো রাজধানীতে একটি শক্তিশালী সংস্থার মাধ্যমে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ-চালানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য দেড় শ থেকে ২শ’ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রায় ২ হাজার স্টাফ দিয়ে একটি সংস্থা গঠন জরুরি। যারা পুরো ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এমন সিস্টেম করতে হবে যাতে কোনো অবস্থায়ই সিরিয়াল ব্রেক করে কোনো বাস ওভারটেক করতে পারবে না। ২ মিনিট পরপর বাস নির্ধারিত লাইনে-স্থানে আসবে-ছাড়বে।