নিউজ ডেক্স:: টঙ্গীর রানীর দাপট কম নয়। সন্ত্রাসী ছেলে, স্থানীয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা—সবই আছে তাঁর। এই ক্ষমতা দেখিয়ে বছরের পর বছর নির্বিঘ্নে ইয়াবা ব্যবসা করে আসছিলেন রানী। টেকনাফ থেকে এক বছরে তিনি এনেছেন দেড় কোটি টাকার ইয়াবা বড়ি।
টঙ্গীর মাদক ব্যবসায়ী সুমাইয়া আক্তার ওরফে রানী (৩৫) এখন কক্সবাজার কারাগারে। ১ মার্চ সিআইডি পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। রানীর সঙ্গে ধরা পড়েছে তাঁর এক সহযোগী ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেনে জড়িত দুই ব্যক্তি। আদালতে দেওয়া পুলিশ প্রতিবেদনে সিআইডি বলেছে, কক্সবাজারের টেকনাফের ইয়াবা ব্যবসায়ী নূরুল হক ভুট্টো ও নূরুল আলমের সঙ্গে রানীর যোগাযোগ আছে। টেকনাফ থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান আসত টঙ্গীতে। সুযোগমতো সেই চালান উত্তরা ও গুলশান এলাকার মাদক সরবরাহকারীদের হাতে পৌঁছে যেত।
সিআইডির বিশেষ সুপার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে যত মাদক কেনাবেচা হয়,তার একটি বড় অংশ আসে টঙ্গী এলাকা থেকে। ট্রেনে করে আনা এই চালান নিয়ন্ত্রণ করতেন রানী নিজেই। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর বিভিন্ন মহল থেকে তদবির আসতে থাকে।
টঙ্গী রেলস্টেশন একেবারেই অরক্ষিত। চারদিকে কোনো সীমানাদেয়াল বা নিরাপত্তাবেড়া নেই। রেলজংশন থেকে উত্তর দিকে কিছুটা গেলেই কেরানীরটেক বস্তি। এই বিশাল বস্তিই হলো রানীর ইয়াবা ব্যবসার মূল কেন্দ্র।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরের পর সরেজমিনে দেখা যায়, বস্তির ভেতরে একটি মাজারের মতো স্থাপনা। স্থানীয় লোকজন জানান, এটি হজরত বেল শাহ্ (র.)-এর মাজার। এই বেল শাহ কী করে বস্তিতে সমাহিত হলেন, তা কেউ জানে না। মাজারের পাশে মাঠ ও রেললাইনের ফাঁকা জায়গায় অনেক মানুষের আনাগোনা। বস্তির একটু ভেতরে যেতেই কয়েকজন যুবক এগিয়ে আসেন, জানতে চান কোথায় যাব। এক যুবক জানালেন, জায়গাটি নিরাপদ নয়। দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন তিনি। বললেন, কিছুদিন আগে এক এনজিওকর্মীকে পুলিশের সোর্স মনে করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেই মামলায় পুলিশ কিছুই করেনি। উল্টো মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়েছে।
বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেরানীরটেক বস্তিতে মাদক কেনাবেচা ও সেবন নিয়ে কোনো রাখঢাক নেই। তবে ঝামেলা এড়াতে মাদক বিক্রি করার আগে বিক্রেতারা ক্রেতার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হন। বস্তির এক বাসিন্দা জানালেন, আগে প্রতিদিন সন্ধ্যা না হতেই গাড়িওয়ালাদের ভিড় হতো কেরানীরটেকে। গভীর রাতে গাড়িগুলো বস্তি থেকে বের হয়ে যেত। গাড়িতে করে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরা থেকে অনেক বড়লোকের ছেলেরা বস্তিতে এসে মাদক সেবন করে চলে যেত। রানী ধরা পড়ার পর সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।
তবে গাঁজা বিক্রি নিয়ে এখনো রাখঢাক নেই ওই বস্তিতে। চাইলে যে কেউ কিনতে পারে। বৃহস্পতিবারও প্রকাশ্যে গাঁজা বিক্রি ও সেবন করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। দুই যুবককে দেখা গেল সিগারেট টানতে। কিন্তু গাঁজার উৎকট গন্ধই বলে দেয় এটা স্বাভাবিক ধূমপান নয়।
আবদুর রহমান নামের এক যুবক বললেন, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভোরে আসা ট্রেনে করে মাদকের চালান আসে কেরানীরটেক বস্তিতে। সেখান থেকে খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সবকিছু রানী একা করেন তা নয়, রানীর পক্ষে জরিনা (৪০), ফাতেমা ওরফে কাউয়ার বউ (৫০), শাহনাজ (৩৫), নূরজাহান (৪৫), রুনা আক্তার (২৫), বিলকিস (৩২), খাদিজাসহ (৩৮) কয়েকজন দেখাশোনা করেন। টাকা লেনদেনের কাজ করেন নাইম হোসেন ও শহিদুল নামে দুই যুবক। এঁদের মধ্যে নাইমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও শহিদুল পলাতক।
রানীর ব্যাপারে খোঁজ নিতে তাঁর বাসা টঙ্গীর হাসান লেনের দত্ত হাউস বিল্ডিংয়ে গেলে কেউ কথা বলতে চাননি। দত্ত হাউস বিল্ডিংয়ের ১৩ নম্বর লেনের পাঁচতলায় একটি বাসায় থাকেন রানী ও তাঁর পরিবার। বৃহস্পতিবার সেখান গেলে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি জানান, রানীর পরিবারের কেউ বাসায় নেই। বাসাটি তালা দেওয়া। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুমাইয়া আক্তার রানীর আদিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দুর্গাপুর থানায়। বাবা সাইফুল ইসলাম পেশায় ফুটপাতের ব্যবসায়ী। মা বেবি আক্তার প্রথম মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। মায়ের হাত ধরেই এ পথে নামেন রানী। তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে দুটি মাদকের মামলা আছে টঙ্গী থানায়। রানীর দুই স্বামী, প্রথম স্বামীর ঘরে দুটি সন্তান আছে। পরে আবার বিয়ে করেন। প্রথম স্বামীর ঘরের দুই সন্তানও মাদক ব্যবসায় যুক্ত। একাধিকবার মাদকসহ ধরা পড়লেও কিছুদিন পরই জামিনে বেরিয়ে যান। এভাবে ছয়-সাত বছর ধরে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন রানী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, রানীকে সহায়তা করেন স্থানীয় সাংসদের চাচা ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান। মতিউরের সঙ্গে রানীর মুঠোফোনে বার্তা আদান-প্রদানের প্রমাণ আছে বলে জানান সিআইডির কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন,‘রানী নামের কাউকে আমি চিনি না, জানিও না। তা ছাড়া আমি ও আমার পরিবার সব সময় মাদকের বিরুদ্ধে ছিলাম। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে আমার ভাইকে প্রাণ দিতে হয়েছে।’
টঙ্গী থানার পুলিশ জানায়, এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি এক এনজিওকর্মী বস্তির ভেতরে ঘোরাফেরা করার সময় পুলিশের সোর্স বলে তাঁকে মারধর করে রানীর ছেলে রাহুল ও তাঁর দলের লোকজন। পরে সেই যুবক হাসপাতালে মারা যান। রানীর ছেলে রাহুল এ মামলার আসামি হলেও পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। রানীর বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা আছে, সবই মাদকের।
কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি—জানতে চাইলে টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল হোসেন বলেন, তিনি এ থানায় নতুন এসেছেন, এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিন আল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ী নূরুল হক ভুট্টো ও নূরুল আলমকে গ্রেপ্তারের পর তাঁরা রানীর খোঁজ পান। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্টদের মাধ্যমে টেকনাফে নূরুল হকের কাছে টাকা পাঠাতেন বিকাশের দুই এজেন্ট শাহজালাল ও সোহেল আহমেদ। এরপর টেকনাফ থেকে বিভিন্ন যানবাহনে তাঁদের ইয়াবা চলে আসত ঢাকায়। এই চক্রের ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। এর মধ্যে টঙ্গীর একটি ব্যাংক হিসাবে তাঁর ২০ লাখ টাকা সঞ্চয়ী আমানত রয়েছে। সেই হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই চক্রের সঙ্গে টেকনাফের নাজিরপাড়ার নূরুল ইসলামের ছেলে নূরুল আলমও জড়িত। তিনিও ইয়াবা পাঠাতেন ঢাকায়। নূরুল আলমের ব্যাংক হিসাবে ২০১৬ সাল থেকে দুই বছরে ১১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা লেনদেনের হিসাব পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিং ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। নূরুল আলমও এখন কক্সবাজার কারাগারে।
রানী কী করে এত দিন ধরে মাদক ব্যবসা চালিয়ে গেলেন? এ প্রশ্ন করা হলে গাজীপুর জেলা পুলিশ কর্মকর্তারা এর জবাব এড়িয়ে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, মাদক ব্যবসা বলুন আর যাই বলুন কোনো কিছুই রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ার বাইরে হওয়ার সুযোগ নেই। তবে এর সঙ্গে যে শুধু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা জড়িত তা নয়, পুলিশও কম দায়ী নয়। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশেরও যোগসাজশ আছে।