এমসি কলেজের সাবেক অধ্যাপক ব্রজেন্দ্র কুমার দাসের পরলোক গমন

‎রোটারি ক্লাব অব সিলেট সেন্ট্রাল এর সাবেক সভাপতি বিকাশ কান্তি দাসের পিতা ও এম সি কলেজ সিলেটের সাবেক গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ব্রজেন্দ্র কুমার দাস (বিকেডি) স্যার পরলোক গমন করেছেন। গত  ১৪ জুন রাত ৫ টা ৪৫ মিনিটের সময় নগরীর তোপখানা ১৬৩ নং  বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর, তিনি দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে তিন মেয়ে সহ আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী,অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী রেখে গেছেন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন।
‎তিনি ৩১ আগষ্ট/১৯২৭ সালে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার জগদীশপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর মাতৃহারা হন এবং বিমাতার স্নেহে লালিত পালিত হয়ে বড় হন। গ্রামে কৃষি কাজ ব্যতিত পড়াশোনার তেমন পরিবেশ ছিলো না। পিতা বিপিন চন্দ্র দাস এর কঠোরতা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম কালিপুর পাঠশালার শিক্ষক কানাইলাল বর্মন এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে আজকের এই সনামধন্য অধ্যাপক ব্রজেন্দ্র কুমার দাস (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ)। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে এম,ই বৃত্তি প্রাপ্ত হন। সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৩টি বিষয়ে লেটার মার্ক সহ স্টারমার্কস পেয়ে ১ম বিভাগে(পূর্ব বাংলায় ৫ম স্থান)  উত্তীর্ণ এবং ১ম কেটাগরীতে বৃত্তি প্রাপ্ত হন। ছাত্রজীবনে খেলাধূলা, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহিতও যুক্ত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন এম.সি কলেজ শাখার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে এম.সি কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। এম.সি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১ম বিভাগে (পূর্ব বাংলায় ৭ম স্থান)  উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশব্বিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত থাকাকালীন সময়ে জগন্নাথ হলের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন।ততকালীন সময়ে ঢাকা বিশব্বিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের সহপাঠীদের নিয়ে গনিত ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে সকল বিভাগীয় অধ্যাপকবৃন্দ উক্ত ক্লাবের সাথে সম্পৃক্ত হন। এছাড়াও ঢাকা বিশব্বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অন্যতম ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে করাচি, পাঞ্জাব ও লাহোর এ অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ভালো একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে এম.সি কলেজ এর ফুটবল টিমের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে অনেক পুরষ্কার লাভ করেন। বিশেষ করে দাবা খেলায় এতটাই পারদর্শী ছিলেন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সহ জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। দাবা খেলার সুবাদে তিনি বিশব্বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক কাজি মোতাহার হোসেন এর বিশেষ স্নেহধন্য ছিলেন। ঈশ্বর প্রদত্ত মেধা নিয়ে কৃতিত্বের সাথে বিশব্বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে নবাব ফয়জুন্নেছা কলেজ, পশ্চিমগাঁ, কুমিল্লা থেকে গণিতের প্রভাষক পদে কর্মজীবন শুরু করেন। অন্যন্য মেধাবী হিসেবে বহু সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরির  প্রস্তাব সম্মানের সহিত প্রত্যাখ্যান করেন। মানুষ গড়ার কারিগরের ধারাবাহিকতায় একই পদে বি,বাড়ীয়া কলেজ এ যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালে কলেজ টি সরকারিকরণ হলে তিনি গনিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে নিজ এলাকায় বদলীর ইচ্ছা প্রকাশ করলে ১৯৮১ সালে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ এ বিভাগীয় প্রধান হিসেবে বদলী করা হয়, পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে এম.সি কলেজ এ বিভাগীয় প্রধান হিসেবে বদলী করা হয়। অধ্যাপক পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে ১৯৮৮ সালে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার ডোমার সরকারি কলেজ এ অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে অধ্যক্ষ হিসাবে নোয়াখালী সরকারি কলেজ হতে ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে চুড়ান্ত ভাবে চাকুরী হতে অবসরে যান। অবসর গ্রহনের পর দক্ষিণ সুরমা কলেজ, সিলেট এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বি,বাড়ীয়া  কলেজ সরকারি করণের পূর্বে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নিং বডির অন্যতম সদস্য এবং শিক্ষক পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বি,বাড়ীয়া থাকাকালীন সময়ে বি,বাড়ীয়া বিজ্ঞান ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি ঐ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনোনীত হন। উক্ত ক্লাব তৎকালীন সময়ে জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত হয়।
‎মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ লিয়াজো অফিস হাইলাকান্দি ও শিলচড়, আসাম, ভারত এ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন সংসদ সদস্য ফরিদগাজী, ফণীভূষণ মজুমদার, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের সাথে আসামের বিভিন্ন জেলায় মুক্তিযুদ্ধের জনমত গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা সমিতিতে অংশগ্রহণ করে তাদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে কোন প্রকার সনদ গ্রহণ করেনি। হিন্দু সম্প্রদায়ের উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি, সিলেট জেলার উপদেষ্টা, মির্জাজাঙ্গাল এ অবস্থিত হিন্দু  অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ছাত্রাবাস পরিচালনা কমিটির দীর্ঘদিনের সভাপতি এবং উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসাথে তিনি বাংলাদেশ গনিত সমিতির প্রাক্তন সদস্য, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, সিলেট জেলার প্রাক্তন কো-চেয়ারম্যান এবং একই পরিষদের সিলেট বিভাগীয় স্টিয়ারিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতি দায়িত্ব পালন সহ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন।
‎মাধ্যমিক স্তরের জন্য গনিতের কথা, জনমিতি,ত্রিকোনমিতি ও ফলিতগনিত বিষয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় বিভিন্ন সময় সাম্প্রতিক গঠনা প্রবাহ নিয়ে প্রচুর লিখালিখি করতেন। শিক্ষার আলো ছড়ানোর মহান পেশায় ব্রতী এই গুনী শিক্ষক নিজের বৈষয়িক চিন্তা কমই করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে সংবর্ধিত ও পুরষ্কৃত হয়েছেন।
‎উত্তরাধিকার
‎সহধর্মিণী রেণুকা দাস, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, ভাতালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিলেট, বড় ছেলে বিকাশ কান্তি দাস (এম.এসসি) (গনিত) অবসরপ্রাপ্ত উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার (অডিট ্ একাউন্টস) স্ত্রী অঞ্জলী রানী তালুকদার, প্রধান শিক্ষক, কিশোরী মোহন বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিলেট, মেজ ছেলে বিভাস কান্তি দাস (বি.এ), কম্পিউটার প্রোগ্রামার, পরিচালক রনি এন্টারপ্রাইজ, সিলেট, স্ত্রী নিলীমা রায়, গৃহিণী, তৃতীয় মেয়ে রঞ্জনা দাস (এম.এসসি) (উদ্ভিদ বিজ্ঞান)  স্বামী ডাঃ নন্দ দুলাল বিশ্বাস, অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা। চতুর্থ মেয়ে ভারতী দাস (এম.এসসি) (ইংরেজি) এম.বিএ সেলফ এম্পোলায়েড স্বামী এড. অনুজ রায়, সিলেট জজ আদালত, পঞ্চম অঞ্জনা দাস (এম.এ) (বাংলা), সহকারী শিক্ষক, ঈশ্বরদী মুনলিট উচ্চ বিদ্যালয়, পাবনা, স্বামী পুলক বিশ্বাস, সেলফ এম্পোলায়েড, পাবনা এবং সর্বকনিষ্ঠ ছেলে ডাঃ কুমার তিতাস দাস এমবিবিএস, ইমারজেন্সি ইনচার্জ, ওমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সিলেট, স্ত্রী ডাঃ শান্তনা দাস তুলি এমবিবিএস, এফসিবিএস, সহকারী অধ্যাপক, রাকিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সিলেট।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *