চলে গেলেন শায়খে রায়পুরী। ঝরে পড়লো ইসলামি রাজনীতির আরেক উজ্জ্বল তারকা। নিভে গেল যুগ সচেতন কর্মবীর এক বরেণ্য আলেমের দীপ্ত জীবন। ২২ নভেম্বর। আমি তখন মক্কার কা’বা চত্বর। হৃদয়টি দুমড়ে মুচড়ে দেয় একটি খবর। শোকাভিভূত হয় দিল মন অন্তর। আমাদের মতো হাজারো ভক্ত অনুরক্তদের শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি চলে গেলেন মহান মাওলার সান্নিধ্যে। এখন থেকে শায়খুল হাদীস মাওলানা মনছুরুল হাছান রায়পুরী এর নামের সাথে যুক্ত হবে রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। শায়খে রায়পুরী শুধুমাত্র স্থানীয় বা জাতীয় রাজনীতিক নন, একটি ইতিহাস, একটি আন্দোলন ও ইলমের এক বিশাল লাইব্রেরি। আজ থেকে ৭৮ বছর পূর্বে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। সুত্রমতে তিনি খলীফায়ে মাদানী মাওলানা হাবীবুর রহমান রায়পুরীর ঔরসে ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মহান আল্লাহ তাআলা তাঁকে মাগফিরাতের চাদরে আবৃত করে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন আমীন।
সম্ভবত ২০১১ সাল। জমিয়তের একটি নিউজ পত্রিকায় প্রকাশ হল। নিউজ পড়ে মাওলানা আব্দুল মালিক চৌধুরীকে জিগ্যেস করলেন আজকের নিউজটি কে পাঠিয়েছে? তিনি আমাকে দেখিয়ে বললেন ‘হাতিমী’। ক’দিন পর সিলেট মহানগর ছাত্র জমিয়তের কাউন্সিল। কমিটি নির্বাচনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি তিনি। সভাপতি হাসান ভাই, সেক্রেটারি বেলাল ভাই, সাংগঠনিক সম্পাদক নিয়ে চলছিল প্রস্তাবনা, সবাইকে থামিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন আপনাদের প্রস্তাবে সভাপতি এবং সেক্রেটারি মেনে নিয়েছি আমার প্রস্তাবটা সাংগঠনিকে মেনে নিতে হবে! সবাইকে অবাক করে তিনি সে-ই নামটি ঘোষণা করলেন শাহিদ হাতিমী। অথচ ক’দিন পূর্বে পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজের আগে হুজুরের সাথে আমার চেনাজানা কোনো স্মৃতি নেই! আহ, কী নেক ধারণাই না করতেন!
২০১৭ সাল। সিলেট মহানগর জমিয়তের কাউন্সিল নিয়ে দেখা দিল তুমুল গ্যাড়াকল। তবুও তিনি মনোনীত হলেন সভাপতি আর সেক্রেটারি হলেন হাফেজ মাওলানা সৈয়দ শামীম আহমদ। কাউন্সিল পরবর্তী সৈয়দ শামীম সাবের বাসায় ছিল এক খুসুসী দাওয়াত। নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকজন ছাড়া সেখানে মাত্র দুজন লোক ছিল অবশিষ্ট, মানে হাতিমী এবং নগরী। কেউ কেউ আমাদের উপস্থিতিতে বিব্রত হচ্ছিলেন! তিনি আমাকে এবং রুহুল আমীন নগরী ভাইকে দেখিয়ে বললেন, এদেরকে আমি দাওয়াত দিয়ে এনেছি। এরা জমিয়তের স্বার্থে এই যুগের চৌকস, আমানতদার ও কাজের মানুষ। আমরা লজ্জিত হলাম। কিন্তু হুজুরের নির্দেশে হাজির থাকলাম! তখন বুঝতে বাকি থাকেনি তাঁর অনন্য কর্মীবান্ধব রাজনৈতিক দূরদর্শিতা!
২০২৩ সাল। চিরচেনা সিলেট নগরীর মহাজনপট্টির মুখে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কাছে গেলাম, যতদূর মনে পড়ে এটাই সর্বশেষ মোলাকাত। পাশে এক লোক আখের রস বিক্রি করছিল। তিনি রসওয়ালার দিকে তাকাচ্ছেন! আমি বুজতে পেরে এক বোতল রস পার্সেল করে দিতে ওর্ডার করলাম। ততোক্ষণে হুজুর আমাকে কিছু গোপন কথা বলতে লাগলেন। করলেন কিছু নসীহতও। শুধরে দিলেন একটি শব্দ প্রয়োগের ব্যবহার। আমি কিছু বাতচিত করি, তিনি অত্যন্ত সহজভাবে সবগুলো শুনলেন। বললেন কেন্দ্রীয় সভাপতি দিয়ে কী হবে? আমরা মেজাজে জমিয়ত বুঝি! আমার মাঝে জমিয়ত আছে কী না এটা মুখ্য। তোমরা আজ আমাদেরকে যেভাবে দেখছো, এসময়টা একদিন শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং পক্ষে বিপক্ষে বাদ দিয়ে, জমিয়ত করো!
শায়খুল হাদীস মাওলানা মনছুরুল হাছান রায়পুরী খলিফায়ে মাদানীর ঔরষে জন্ম গ্রহণকারী শায়খে রায়পুরী সৌভাগ্যবান, অনন্য মেধা ও মননের অধিকারী এক রাজনৈতিক বোদ্ধা। যোগ্য বিজ্ঞ আলেম । মরহুম সদরে জমিয়ত কায়িদে উলামা হযরত শায়েখে কৌড়িয়া, বাবায়ে জমিয়ত হযরত শায়েখে বিশ্বনাথী, ফিকরে জমিয়ত হযরত শায়েখে আকুনী, হযরত শায়েখে বারোকোটি রাহ.সহ জমিয়তের প্রাণখ্যাত হযরত মাওলানা শামসুদ্দিন কাসিমী, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ও মুফতি ওয়াক্কাস রাহ.দের রাজনৈতিক সুহবতে গড়ে ওঠা জমিয়তের সর্বাপেক্ষা প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও একসময়ের সিলেট জমিয়তের সাংগঠনিক দিকপাল ছিলেন তিনি।
ভিন্নমত ও সাংগঠনিক গ্যাড়াকলে সময়ের বিবর্তনে জীবনের সমাপ্তিলগ্নে তিনি রাজনৈতিক জমিয়তের একাংশের কর্মঠ এক কাফেলার কান্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ইসলামী রাজনীতিকে প্রচলিত রাজনৈতিক ধান্ধার সংমিশ্রণ কবল থেকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে মর্যাদার লড়াইয়ে যিনি অবিচল। সত্তরোর্ধ্ব বয়েসের অধিকারী দলীয় এই রাহবার দিনরাত সমগ্র দেশের আনাচে কানাচে বিরামহীন প্রোগ্রামে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশলে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। কুরআনের হাফিজ হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন অসংখ্য অগণিত হাদিসের হাফিজ। ছিলেন ক্ষুরধার তেজস্বী লেখনীর অধিকারী, ও প্রখর মেধাবী। ফেকাহ, ফতোয়া, তাফসির ও রাজনৈতিক বিষয়ে ছিলো তার সমান সমান দখল।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ একাংশের সভাপতি, শায়খুল হাদীস হাফিজ মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী ছাত্র জমানায় জামেয়া হুসাইনিয়া গহরপুর সিলেট, মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী চট্টগ্রাম, জামেয়া বালিয়া মোমেনশাহী মাদরাসায় সুনামের সাথে অধ্যয়ন করে হিফজুল কুরআন ও দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। তিনি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররামের দীর্ঘদিনের খতিব- সিলেটের কৃতি সন্তান, আল্লামা উবায়দুল হক রহ.- এর বড় জামাতা।
কর্মজীবনে তিনি জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর সিলেট-এর মুহাদ্দিস, বাহদুরপুর আলিয়া মাদ্রাসা শরীয়তপুরের হেড মুহাদ্দিস ছিলেন, নেত্রকোনা কলমাসিন্দুর মাদরাসায় দীর্ঘদিন হাদিসের খেদমতসহ সিলেট শহরের মদীনাতুল উলুম দারুসসালাম মাদরায় মুহাদ্দিস ছিলেন। এছাড়াও জামিয়া আল মাদানিয়া খেলাফত বিল্ডিং সিলেট ও জামিয়া হুসাইনিয়া দক্ষিনকাছ মাদরাসা, জামিয়া ইসলামিয়া ক্বাওমিয়া দারুল হাদিস মুন্সীবাজার মৌলভীবাজার এর শায়খুল হাদীস ছিলেন। সর্বশেষ তিনি জামেয়া আরাবিয়া নতুনবাগ খিলগাঁও ঢাকার শায়খুল হাদীস হিসাবে দায়িত্বরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তিনি একজন প্রজ্ঞাবান লেখক। ইলমি বিষয়ে কয়েকটি কিতাব রয়েছে। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবেও সফল, তাঁর স্বত্বাধীন হুসাইনিয়া কুতুবখানা একসময় সিলেটের উলামায়ে কেরামের মারকাজ ছিল।
ইন্তেকালের সংবাদ টাইমলাইনে দেখার পর থেকে কোনোভাবে ভুলতে পারছি না হুজুরকে। উপস্থিত হতে পারবো না জানাজায়। স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠছে বারবার। স্মৃতি দিনের কথাগুলো আলোড়িত করছে তনুমন। আমি শোকাভিভূত। সমবেদনা জানাচ্ছি পরিবারসহ সবার প্রতি। হ্যা, শায়খুল হাদীস মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কথাই লিখছি। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রব্বে কা’বা হজরতকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করুন, আমিন। আমাদের প্রয়োজনে আরো কয়েকটা বছর হজরত বেঁচে থাকাটা কাম্য ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকতেই হবে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রা’জিউন।