‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে ২টা মিনিট কথা বলতে দেন’

স্পোর্টস ডেস্ক : সিরিজের মাঝপথে অধিনায়কের আচমকা জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকার রেওয়াজ খুব একটা নেই। গতরাতে তামিম ইকবালের ব্যতিক্রমী এ সম্মেলন ডাকার পরই ঝড়ের আঁচ করা যাচ্ছিল। বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে তামিম যে ঘোষণা দিলেন, সেটি ঝড় নয়; রীতিমতো টর্নেডো বয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা।

ধারণা করা হচ্ছিল তামিম অধিনায়কত্ব ছাড়বেন; সেখানে ক্রিকেটকেই বিদায় বলে দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা এ উদ্বোধনী ব্যাটার। নিজ শহরের মাটিতে গতকালই আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ফেলেছেন বলে জানিয়েছেন ৩৪ বছর বয়সি তামিম।

তামিমের সংবাদ সম্মেলনে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। কোলাহলের মধ্যে তামিম এসে সবাইকে অনুরোধ করেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে দুটা মিনিট কথা বলতে দেন।’ এর পর অবসরের ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে তামিম বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই সঠিক সময় সরে দাঁড়ানোর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে। সবাইকে ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন।’

সংবাদ সম্মেলনে তামিমের গলা ধরে আসে। কান্নাভেজা কণ্ঠে কিছুটা ডুকরে উঠে সময় নিয়ে বলেন, ‘আমি সব সময়ই একটা বলেছি, আমি ক্রিকেট খেলি আমার বাবার স্বপ্নপূরণের জন্য।’

ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তামিমের। ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কেনিয়ার বিপক্ষে দেশের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলেছিলেন। সেই থেকে ১৬ বছর টানা খেলছেন জাতীয় দলে। আর তাই তো ক্রিকেটটাকে সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন!

বিদায়বেলায় বারবার কেঁদেছেন এই ড্যাশিং ওপেনার। চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছছিলেন। বারবার টিস্যু ভিজে যাচ্ছিল।

বিদায়ের কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ ধরে আসে। আবেগের জায়গা যে ক্রিকেট! জীবনের সোনালি সময়টুকু দেশের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছতে দেখা যায় তাকে। সিদ্ধান্তটি হুট করে নেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।
‘এটার পেছনে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা নিয়ে ভাবছিলাম আমি… এটার ভিন্ন ভিন্ন কারণ আছে, যেটা আমার মনে হয় না এখানে বলার দরকার আছে। এটা না যে হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বেশ কিছু দিন ধরেই কথা বলছিলাম, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলছিলাম। আমার মনে হয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর উপযুক্ত সময় এটিই।’

সম্প্রতি চোট নিয়ে বেশ ভুগছিলেন তামিম। চোটের কারণে গত ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে খেলতে পারেনি তিনি। পিঠের নিচের অংশের পুরনো ব্যথা মাথাচাড়া দেওয়ায় কিছু দিন আগে খেলতে পারেননি আফগানিস্তানের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে। চলতি ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগের দিনও তিনি জানান যে, শতভাগ ফিট নন। প্রথম ম্যাচ খেলার পর অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন। শেষ পর্যন্ত তার সেই সিদ্ধান্ত চোট-টোটের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল ক্যারিয়ারের শেষ বিন্দুতে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার বিচরণ শুরু সেই ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। চাচা আকরাম খান ও বড়ভাই নাফিস ইকবালকে অনুসরণ করেই তিনি পা রাখেন ক্রিকেটের পথে। ১৮ ছুঁই ছুঁই বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায় ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। স্রেফ চার ওয়ানডের অভিজ্ঞতায় খেলতে যান বিশ্বকাপে খেলতে নেমে প্রথম ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে স্মরণীয় এক জয়ে দাপুটে ফিফটি করে নজর কাড়েন ক্রিকেটবিশ্বের।

বিদায়ী সম্মেলনে তাদের স্মরণ করেন তামিম। ‘আমি সব সময় বলেছি— ক্রিকেট খেলেই বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে গিয়ে অনেক পরিস্থিতির মুখে পড়েছি, সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার ছোট চাচার হাত ধরেই ক্রিকেটে এসেছি। যারা আমাকে এ পর্যায়ে আনতে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তামিম আজ অধিনায়কত্বসহ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই অবসরের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। তাও আবার ওয়ানডে বিশ্বকাপের ঠিক তিন মাস আগে! এ ঘোষণার আগে বিসিবি কিংবা ক্রিকেট বোর্ডের কোনো পরিচালকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেননি তিনি। একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে তামিম এই অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন।

গত পরশু সিরিজ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে আনফিট হলেও আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলবেন বলে ঘোষণা দেন ওয়ানডে অধিনায়ক। শতভাগ ফিট না হয়েও তামিমের ম্যাচ খেলার ঘোষণায় বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে এবং বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন৷

মাথার ওপর বিশাল চাপ নিয়ে বুধবার আফগানদের মুখোমুখি হয়ে ব্যর্থ হন তিনি। বুধবার প্রথম ওয়ানডেতে ১৩ রানের বেশি করতে পারেননি৷ দলও হেরেছে আফগানিস্তানের কাছে৷পরে ফিল্ডিংয়ে খুব ভালো অবস্থানে পাওয়া যায়নি তামিমকে। স্পষ্ট বোঝা যায় ফিটনেস ঘাটতি।

সবকিছু মিলিয়ে এখনকার বাস্তবতা তামিমের বিপক্ষেই।

বিদায়ী সম্মেলনে দেশসেরা ওপেনার সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি আমার সব সতীর্থকে ধন্যবাদ জানাই, আমাকে এত বছর ধরে সাপোর্ট করার জন্য। ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই, আমাকে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ায়। ধন্যবাদ জানাই আমার শৈশবের কোচকেও। আমার চোট চাচা যিনি কিছু দিন আগে মারা যান তার কাছ থেকে আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমি আমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়া আমার জন্য সহজ নয়। আসলে আমার খুব বেশি কিছু বলার নেই। আমি একটা জিনিসই বলতে চাই সেটি হলো— আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি ভালো খেলার। আমি আসলেই নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমি কতটা ভালো খেলোয়াড় ছিলাম, আদৌ ভালো ছিলাম কিনা, আমি জানি না। তবে আমি সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমি যখনই মাঠে নেমেছি আমি আমার শতভাগ দিয়েছি।’

বিদায়বেলায় তার নামের পাশে ৭০ টেস্টে ৩৮.৮৯ গড়ে রান ৫ হাজার ১৩৪। সেঞ্চুরি ১০টি, ফিফটি ৩১টি। টেস্টে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরি তার।
ওয়ানডে ২৪১টি খেলে ৩৬.৬২ গড়ে রান ৮ হাজার ৩১৩। ১৪ সেঞ্চুরির পাশে এখানে ফিফটি ৫৬টি। এই সংস্করণে দেশের হয়ে রান, সেঞ্চুরি, ফিফটি, সবকিছুতেই তিনি সবার ওপরে।
৭৪ ম্যাচে ১ হাজার ৭০১ রান নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলেছেন গত জুলাইয়েই। এই সংস্করণে দেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান তিনি।  তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১৫ হাজার রান করা দেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার সেঞ্চুরি ২৫টি। বাংলাদেশের হয়ে ২০ সেঞ্চুরিও নেই আর কারও।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *