পুঁথিসম্রাট জালাল খান ইউসুফী পুঁথিসাহিত্যের বিরল প্রতিভা

আবুল বাসার সেরনিয়াবাত: পুঁথি আমাদের সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্যের এক অনবদ্য অংশ। এক সময় বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ও প্রতিটি পাড়ায় ঘরে ঘরে ছিল পুঁথিপাঠের রেওয়াজ। সন্ধ্যায় রাত হয়ে গেলেই কুপি জ্বালিয়ে শুরু হত পুঁথিপাঠের আসর। সে সময় পুঁথিপাঠককে ঘিরে গ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মনোযোগ সহকারে পরিবাবের সবাই শুনতেন পুঁথিপাঠ।প্রাচীনকালে মূলত প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরাই ছিল পুঁথি অনুরাগী। তাদের লেখাপড়া বা ভাবনা-চিন্তার পরিধি আটপৌরে হলেও অন্যরা যে একে অবহেলা করতো, তা কিন্তু নয়। সেকালে পুঁথি ছিল সার্বজনীন। শিশু-কিশোর-বয়স্ক নির্বিশেষে সকলের কাছেই পুঁথি-সাহিত্যের অনুপম কাহিনিগুলো ছিল অমৃততুল্য। আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতার দাপটে বাস্তবতায় প্রাচীন পুঁথিকাব্য, পুঁথি-কাহিনি বিক্ষিপ্ত ও বিলুপ্ত প্রায় হলেও আজো মানুষ ফিরে যেতে চায় স্বপ্ন, কল্পনা ও বাস্তবতার মিশেলের সেই বিমূর্ত নান্দনিক স্টেশনে, যেখানে পুঁথিসাহিত্যের মিথ কল্পকথা, লোক-কাহিনী, লোকাচার, ধর্মকথা, রাজবন্দনা, হাসি-কান্না, যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গের রূপচ্ছটায় বিরাজ করে অলৌকিক আনন্দ ভুবন। বারো আউলিয়ার বাংলাদেশ। শাহজালাল পুন্য ভুমি আধা‌ত্নিক  রাজধানী, ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট যার জন্মভুমি।এ সিলেটী ভাষায় ওলি-আউলিয়ার জীবন কাহিনী নিয়ে দেশবিদেশে এক সু পরিচিত খ্যতিমান কবি নাম। বাংলার আনাচে কানাচে পুঁথিকাব্য বিলুপ্ত হয়ে পুরাতন পুঁথিকাব্য এ সমাজে খোঁজে পাওয়া কঠিন। এসব পুঁথি নিয়ে জাতীয় ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সিলেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কাব্যকথা সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জালাল খান ইউসুফী। লোকজ সংস্কৃতির এ অভিবাবক হিসেবে দেশের আনাচে কানাচে পৌছে দিচ্ছেন লোকজ সংস্কৃতি র্বাতা । পুঁথিকাব্য ও লোকজ সংস্কৃতি সাহিত্য জগতে বাংলার এক জনপ্রিয় নাম। যাকে অনুস্বরন করে তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন পুঁথিকার ও পুঁথিশিল্পী।যার অক্লান্ত শ্রমের কারণে পুঁথিসাহিত্যের জয় জয়কার সর্বত্র বলা চলে। জালাল খান ইউসুফী মূলত কবি হলেও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি সিলেট জেলার ওসমানীনগরে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পুঁথিকবি ইউসুফ খান। মা সুরতুননেছা ছুরতি, প্রয়াত। দশ ভাইবোনের মধ্যে কবি তৃতীয়। তিনি বাবার হাত ধরে লোকসংস্কৃতির অন্যতম শাখা পুঁথিসাহিত্যে প্রবেশ করে পরবর্তীতে আধুনিক সাহিত্যে উঠে এসে একাধিক অঙ্গনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিশেষত তিনি লোকসংস্কৃতির পুঁথিসাহিত্য গবেষক,পুঁথি রচয়িতা ও পুঁথিশিল্পী। পুঁথির একাধিক সুর ও ছন্দে পুঁথিসাহিত্য চর্চা করলেও নতুন নতুন সুর ও ছন্দ খুঁজে ফিরেন। তাঁর লেখা প্রথম পুঁথিকাব্য প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালেজ্জ ৮৮’র বন্যার কবিতা। সেই থেকে এপর্যন্ত শতাধিক পুঁথিকাব্য প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও গল্প-উপন্যাস-কবিতা-ছড়া-প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৫০ উর্ধ্ব। তাঁর ছোট ভাই দু’জন সংস্কৃতি চর্চা করেন। জালাল খান ইউসুফী ১৯৯২ সালে ইউনিসেফ বাংলাদেশ থেকে পুঁথিকাব্যের জন্য প্রশংসাপত্র অর্জন করেন। সরকার অনুমোদিত ‘উদার দিগন্ত সাহিত্য সংসদ ও পাঠাগার’ থেকে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে পুঁথিসম্রাট উপাধিতে ভুষিত হন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ সাহিত্য উৎসবে পুঁথিসম্রাট হিসেবে সংবর্ধিত ও কক্সবাজারের উখিয়ায় পালং সংবর্ধনায় ভূষিত হয়েছেন। কিছুদিন পূর্বেও ভাবা যেতো না যে, আমাদের লোকসংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া অন্যতম শাখা পুঁথিসাহিত্য আবারও নতুন করে ফিরে আসবে। জালাল খান ইউসুফীর চেষ্টা ও সাধনায় এখন সর্বত্রই বলা চলে পুঁথিসাহিত্যের জয় জয়কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য লোকসংস্কৃতির প্রকাশিত গ্রন্থজ্জপুঁথিকাব্যে মুক্তিুযুদ্ধের ইতিহাস, পুঁথিকাব্যে সাত বীরশ্রেষ্ঠ, বাংলাদেশের পুঁথিকাব্য (গবেষণাগ্রন্থ), আমাদের বাংলা পুঁথিসাহিত্য (গবেষণাগ্রন্থ), মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের পুঁথি (গবেষণাগ্রন্থ), জালাল গীতি (লোকগীতিগ্রন্থ), পুঁথিকবি ইউসুফ খানের পুঁথিকাব্য সমগ্র (সম্পাদিত গবেষণাগ্রন্থ) ইত্যাদি।এছাড়াও তিনি লিখেছেন- মুজিববর্ষের পুথি, মুজিবনামা, শোক দিবসের পুঁথি, হাসুনামা পুঁথি, পনের আগস্টের পুঁথি, বাঙালি সংস্কৃতির পুঁথি, স্বাধীনতার পুঁথি, বিজয়নামা পুঁথি, ভাষা দিবসের পুঁথি, শেখ রাসেলের পুঁথি, পদ্মাসেতুর পুঁথি, বোশেখের পুঁথি, বঙ্গাব্দের পুঁথি, মে দিবসের পুঁথি, মুক্তিযুদ্ধের পুঁথি, মুহিতনামা পুঁথি, সামাদনামা পুঁথি, মুনূহুনামা পুঁথি, সিলেটনামা পুঁথি, কক্সনামা পুঁথি, বরিশালনামা পুঁথি, সুনামগঞ্জ বিলাস পুঁথি, গ্রীষ্মনামা পুঁথি, বর্ষামঙ্গল পুঁথি, শরৎনামা পুঁথি, হেমন্তের পুঁথি, উন্নয়নের পুঁথি, শাহ আব্দুল করিমনামা পুঁথি, কালরাত্রির পুঁথি ইত্যাদি। তিনি পুঁথি ও পথকবিতার সর্বশেষ সফল কবি। তাকে পথকাব্যের জীবন্ত কিংবদন্তি বললেও ভুল হবে না। কারণ নব্বই দশকে তার রচিত শতাধিক পথকবিতা হাটেবাজারে পঠিত ও বিক্রয় হতো। সে সময়ে তার রচিত ও প্রকাশিত উল্যেখযোগ্য পথকবিতা- ৮৮’র বন্যার কবিতা, রাক্ষসী প্রেম, রোকেয়া বিবির করণ কাহিনি, মনির খুকুর ফাঁসি, স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যা, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, পুঁথিকাব্যে বঙ্গবন্ধুর জীবনী, তোরাব আলী ও রোকেয়া সুন্দরীর প্রেমকাহিনি, লাইলী মজনুর প্রেম কাহিনী, সুচরাজা ও সুকপাখীর কবিতা, এরশাদের পতন, ঈদের দিনে স্বামী হত্যা, বাঁশের বাঁশরীর সুরে-পাগল করল যুবতীরে, এরশাদ শিকদারের ফাঁঁসি, হযরত শাহ জালাল (র.)-এর জীবনী, লাশের সাথে টিভির দাফন, আফগানিস্তান আমেরিকার যুদ্ধ, খোদার গজব, ইরাক আমেরিকার যুদ্ধ, খোদার গজব দারুণ কড়া-জামাই শাবাশুড়ী লাগছে জোড়া, এই সেই সাদ্দাম, চিত্রনায়ক সালমান শাহর রহস্যময় মৃত্যর কাহিনি, চিত্রনায়ক মান্নার অকাল মৃত্যু, মিয়ানমারে গণহত্যার কবিতা, পিতার হাতে ছেলে কোরবানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার দায়ে ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড, রক্ত মাংস খেয়ে ৩ সন্তান হত্যার কাহিনি, জন্মগত হাফেজ শেখ শরফুদ্দিন আল খলিফা, মোনাজাতে দরবারে এলাহি, কল্যাণপুরের বস্তিতে আগুন, মামী ভাগিনার প্রেম কাহিনি, মামী ভাগিনার প্রেমলীলা, জামাই শ্বাশুড়ীর প্রেমলীলা ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ- বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা বিশ্ববন্ধু (শিশুকিশোর ছড়াগ্রন্থ), ১৫ আগস্টের শোকগাথা শোককথা (সম্পাদিতগ্রন্থ), একাত্তরের কিশোর যোদ্ধা (কিশোরগল্পগ্রন্থ), লেখালেখির কলাকৌশল (প্রবন্ধগ্রন্থ) নজরুলনামা (নজরুলের জীবনী পুঁথি), নির্বাচিত ৫টি উপন্যাস, শুভ্র তুলোর নাও (কিশোর কাব্যগ্রন্থ), চিরিপ চিরিপি কিরিপ কিরিপ (ছড়াগ্রন্থ), নীল সবুজের পাল (কিশোর কাব্যগ্রন্থ), ভমভম ভমকে (ছড়াগ্রন্থ) ইত্যাদি।
জালাল খান ইউসুফী কাব্যকথা প্রকাশনীর প্রকাশক, সাহিত্য পত্রিকা মাসিক কাব্যকথা’র সম্পাদক ও সাহিত্য সংগঠন কাব্যকথা সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন এবং ইউসুফী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রধান পৃষ্টপোষক ও উপদেষ্ঠা।আঠারো-উনিশ শতকে সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিকশিত নাগরী লিপিতে প্রচুর পুঁথি লিখিত হয়েছে। নাগরী লিপিতে পুঁথি লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- শীতালং শাহ্, আরকুম শাহ্, শাহনুর শাহ্, আফজল শাহ ওরফে আরমান আলী প্রমূখ। সিলেটের খ্যতিমান পুঁথিকারদের উত্তরসুরি হিসেবে বাংলা ভাষায় পুঁথিকাব্য রচনা করছেন জালাল খান ইউসুফী। তিনি কাব্যকথা সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার ঝরে পরা মেধাবী কবি সাহিত্যিকদের জাতীয় ভাবে তোলে ধরে নবীন প্রবীণ কবি সাহিত্যিকদের মেলবন্ধন সৃষ্টিকারি একজন মানুষ। তেমনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের সেতুবন্ধন হচ্ছে পুঁথি। একারণে সুদূর অতীত থেকেই পুঁথিসংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা দৃষ্ট হয়। এদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রথম পুঁথি সংগ্রহে হাত দেন কয়েকজন বৃটিশ নাগরিক। তাদের মধ্যে বাংলা ব্যাকরণের আদি রচয়িতা নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) অন্যতম। তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮৩ সালে বাংলাদেশে অবস্থানকালে ১২টি বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন, যা পরে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অর্থের বিনিময়ে প্রদান করে ছিলেন।জালাল খান ইউসুফী মধ্যযুগীয় পুঁথিসাহিত্য যা আজ বিলুপ্তপ্রায় তাকে আধুনিক অলংকারে হারানো পুঁথিকাব্যকে আবেদনময় রেখে যুগোপযোগী করে আমাদের সমাজে তুলে আনেন। তাঁর পুঁথিকাব্যের ছন্দ তাল আর মোহনীয় সুরের যাদু পাঠক শ্রোতার মনে মুগ্ধতা এনে দেয় অনায়াসে। তাই নিঃসংকোচে ভক্ত পাঠক ও শ্রোতারা যাঁকে পুঁথিসম্রাট অভিধায় অভিসিক্ত করে রেখেছে, তিনি গণমানুষের কবি জালাল খান ইউসুফী। চিরায়ত গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে বুকে লালন করে বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্যবৃক্ষে সেচ ও সার দিয়ে যাচ্ছেন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। স্বভাবজাত এ চারণ কবি পথে পথে ঘুরে মানুষের জীবন আলেখ্য লেখেন সহজ সরল ভাষায় পুঁথির ছন্দ ও সুরে। সমাজ, রাজনীতির নানা পট-পরিতর্ন, জীবনের জটিলতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দ্বন্ধ, আনন্দ-বেদনা, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও কালের উল্লেখযোগ্য কাহিনিকে উপজীব্য করে তিনি রচনা করে যান কখনো পয়ারে, কখনো লঘু পয়ারে, কখনো অক্ষরবৃত্তে, কখনো মাত্রাবৃত্তে অথবা স্বরবৃত্ত ছন্দে কাব্যের সহজ-সরল ভাষায়। বিজ্ঞান ও শিল্প বিপ্ল¬বের এ আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে কবি এক দক্ষ কারিগরের পরিচয়ে স্বকীয়তা রাখেন। সময়ের চাওয়া-পাওয়া মাথায় রেখে পুঁথিকে আধুনিক সমাজ উপযোগী করে তুলেছেন। গাঁয়ের মেঠোপথ, লাঙল জোয়ালের বাঁধন কেটে পুঁথিকে তুলে এনেছেন শিক্ষিত সমাজের ড্রইং রুমে কিংবা বন্ধুদের চায়ের আড্ডায়। এতে তাঁর শিল্পশ্রী খুব সহজেই অনুমেয় হয়। সময়কে ধারণ করে পুঁথিসাহিত্যকে বহতা নদীর মতো তরঙ্গায়িত করে প্রবাহিত করে যাচ্ছেন । তাঁকে যুগস্রষ্টা পুঁথিশিল্পী বললে হয়তো অত্যুক্তি করা হবে না। গতানুগতিক সুর ও পাঠের ঢং ভেঙে তিনি অসংখ্য সুরে পুঁথি রচনা ও পাঠের চাল দেখিয়ে যাচ্ছেন সফল ভাবে। এমনকাজ একজন শক্তিমান স্বভাবজাত লেখকের পক্ষেই সম্ভব। আমরা মধ্যযুগীয় পুঁথিকবিদের পুঁথিকাব্যে মনোনিবেশ করলে দেখতে পাই সে সময়ের পুঁথিকবিগণ পয়ার, ত্রিপদী দুটি ছন্দেই চর্চা করেছেন, তার বাইরে, লঘু-ত্রিপদী, চৌপদী ও পঞ্চপদী ছন্দে দু’একজন লিখেছেন, কিন্তু আমাদের আলোচ্য পুঁথিকার জালাল খান ইউসুফী পয়ার, লঘু পয়ার, ত্রিপদী, লঘু-ত্রিপদী, ত্রিপদী ভাটিয়ালী, পঞ্চপদী ভাটিয়ালী, কাব্যসুর বা সহজ সুর, ধুয়া, কাটাধুয়া, ষষ্ঠপদী ধুয়া, ভাওয়াল জারী সুর, পালাসুর, বন্ধুহে সুর, মজিদী সুরসহ নানান সুর ও ছন্দে লিখতে এবং পড়তে পাড়ার এক পুঁথিকারিগর। এদিক দিয়ে বলা যায় বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে এমন প্রতিভা বিরল। তার লেখার মধ্যে রয়েছেন রোকেয়া বিবির করুণ কাহিনী, বঙ্গবন্ধুর জীবনী, শোকদিবসের পুঁথিকাব্য, নজরুলনামা (নজরুলের জীবনী), মুক্তিযুদ্ধের পুঁথি, সাত বীরশ্রেষ্ঠের জীবনী, হজরত শাহজালালের (র.) জীবনী, পিতায় করছে ছেলে কোরবানী, এরশাদ শিকদারের রোম-হর্ষক জীবন কাহিনী, শাহ আব্দুল করিমের জীবনী, শুকপাখি ও কাজল রেখা ইত্যাদি পুঁথিকাব্যে তাঁর কর্মের উজ্জ¦ল স্বাক্ষর বিদ্যমান। যেমন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখে জীবন কাহিনী পুঁথিকাব্যর দৃষ্টান্ত- বেতনে তার ঘর চলে না,এই কথা কাউকে বলে না,অন্য কাজের আশা মনে রয়, উন্নিশ’শ উনষাটের মার্চে মিলিটারী চাকরি হয়,ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাকে সাধারণ এক সৈন্য করে লয়, প্রথমে প্রশিক্ষণ চলে, তারপরে তার পোষ্টিং হলে,তিন ডিসেম্বর দিনাজপুরে যান,সাড়ে দশটি বছর নূরে দিনাজপুরে দিন কাটান,উন্নিশ’শ সত্তুরের জুলাই হেডকোর্য়াটার যশোরেতে যান, যশোরে তার ডিউটি চলে, সত্তুরে নির্বাচন হলে, চারদিকে হয় শেখ মুজিবের জয়, শাসকগোষ্ঠীর সহ্য হয়নি নৌকা মার্কার এই বিজয়,পঞ্চপদী ধুয়া রেখে অন্য সুরে বলবো তা নিশ্চয়, এ সুরটি পঞ্চপদী ধুয়ার সুর নামে পরিচিতি অর্জন করেছে ইতোমধ্যে। আবার তিনি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের জীবন কাহিনী পুঁথিকাব্য ধুয়ার সুর ব্যাবহার করেছেন এভাবে-বিসমিল্লা জবানে পড়ি,বন্দনা গান শুরু করি, স্বরণ করি প্রভু নিরঞ্জন, দ্বিতীয় বন্দনা করি রাসুলুল্লার পাক চরণ,যার খাতিরে নিরঞ্জনে ও গড়েছেন সুন্দর এই ভুবন,তৃতীয় বন্দনা আমার, জন্মদাতা পিতা মাতার, চতুর্থে ওস্তাদের রাঙা পায়,পিতা-মাতা-ওস্তাদ-গুরু আজকে যাদের উছিলায়, লিখতে পারি গাইতে পারি ও ঘুরি স্বাধীন এ বাংলায়, পঞ্চমেতে বন্দনা গাই, পাঠক-শ্রোতা-ভগ্নি আর ভাই, সালাম-আদাব-শুভেচ্ছা জানাই,চলোরে ভাই পাঠক শ্রোতা একাত্তর সালেতে যাই, মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও যুদ্ধের বিজয়গাথা গাই, আবার তিনি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জীবন কাহিনী পুঁথিকাব্যে প্রচলিত ত্রিপদী ছন্দ ব্যবহার করে বন্দনা গেয়েছেন এভাবে- ওহে দয়াবান প্রভু,গোনাগার আমি তবু, তোমার করুণা প্রভু চাই,নবীর উম্মত সারা, তোমার করুণা ছাড়া,তরে যেতে কোনো পথ নাই, তোমার হাবীব নবী, তাঁর শাফায়াত কবি, পরকালে চায় হে মহান,তার শাফায়াত বিনে, এ অধম দ্বীনহীনে,করুণা চাহে না এ নাদান,তাই সে রাসুল স্বরি, হাজার দরূদ পড়ি, লেখিবার শক্তি কিছু চাই,মধুমাখা ছন্দ দাও,  কলম চালিয়ে নাও, সর্বময় শক্তি তব শাঁই,মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই যে সর্বময় ক্ষমতার আধার, তাই তিনি বর্ণনা করেছে এবং পিয়ারা হাবিবের প্রশংসাও গেয়েছেন এসময়ের পুঁথিছন্দের যাদুকর জালাল খান ইউসুফী। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জীবন কাহিনী পুঁথিকাব্যে ত্রিপদী ভাটিয়ালী ছন্দে লিখেছেন- যুদ্ধ করে মুক্তিসেনা পাকিস্তানের ভিত নাড়ায়, সিপাহী মুস্তফা কামাল যুদ্ধে প্রাণ হারায়, কি বলবো যুদ্ধের কাহিনি একাত্তরের কথা,রক্ত নদী মূল্য দিয়ে পেলাম স্বধীনতা, স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পাকিস্তানে হাত বাড়ায়, সিপাহী মুস্তফা কামাল যুদ্ধে প্রাণ হারায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান,রেসকোর্স ময়দানে শোনান স্বাধীনতার গান,নেতার ডাকে যার-যা-ছিল তাই নিয়ে সব যুদ্ধে যায়, সিপাহী মুস্তফা কামাল যুদ্ধে প্রাণ হারায়,  ইউসুফী আবার কাটাপয়ার ব্যবহার করে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জীবন কাহিনী পুঁথিকাব্যে লিখেছেন-প্রথমে বন্দনা করি মালেক শাই, কোনো কালে যাহার সমান কেহ নাই, পয়গম্বর বন্দনা করি দ্বিতীয়া, তার প্রশংসা করবো আমি কী দিয়া, শ্রেষ্ঠ নবী রাসুল তিনি আল-আমিন,পরকালে পাপিগণের যে জামিন, মহান প্রভুর হাবিব নবী সরোয়ার,তার উছিলায় ক্ষমা করো পরোয়ার,পুঁথি তাঁর প্রাণের সাথে মিশে থাকলেও সাহিত্যের অন্য শাখা গুলোতেও জালাল খান ইউসুফীর সফল বিচরণ আমরা দেখতে পাই। আধুনিক কবিতা, ছড়া, উপন্যাস ও ছোটগল্পেও তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস-
ফুলের কাঁটা, স্মৃতি, দু’মুঠো মাটি, চাঁদের পরশ, নীল ঢেউ, ছুঁয়ে যাই ইত্যাদি। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পগ্রন্থ জেলে ও ডাকাতের গল্প, বৃষ্টি গিয়েছিল পরীর দেশে, একাত্তরের কিশোর যোদ্ধা, যামদো ও রামদো ভূতের গল্প, সাত যুবকের ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে থাকার গল্প ইত্যাদি। কিশোর কাব্যগ্রন্থ- শুভ্র তুলোর নাও, নীল সবুজের পাল, চিরিপ চিরিপ কিরিপ কিরিপ, ভম ভম ভমকে। এছাড়াও নতুন লিখিয়ে বন্ধুদের জন্য লিখেছেন- লেখালেখির কলাকৌশল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক যুগের পুঁথিসাহিত্যের ইতিহাস নতুন সংযোজন তাঁর সংকলিত, বাংলাদেশের পুঁথিকাব্য গ্রন্থ। তার লেখা রোমান্টিক কবিতা পাঠে আমরা তার প্রেমিক হৃদয়ের পরিচয় পাই। বিরহী কপোতের মতো তিনি তাঁর কাব্যে রচে যান ব্যথিত হৃদয়ের আর্তনাদ-আমার ব্যথায় আমিই কাঁদি আমার দুখে কেঁউ কাঁদে না কষ্ট ব্যথার মনের সাথে কারো হৃদয় কেউ বাঁধে না দাগ লাগা এক মনের মাঝে নতুন যে কেউ দাগ দাগে না ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না কিচ্ছু আমার ভাল্লাগে না -কবি জালাল খান ইউসুফীর কবিতার বিষয় বৈচিত্র ব্যাপক ভাবে পরিলক্ষিত হয়। অগাধ দেশপ্রেম ও প্রকৃতি প্রেমে পূর্ণ তাঁর শুভ্র তুলোর নাও কিশোরকাব্য গ্রন্থে বিচিত্র ধরনের লেখার মধ্যথেকে বর্ষাকালের ছবি কবিতাটি তুলে ধরছি- বৃষ্টি ঝরে বৃষ্টি পড়ে টুম-টুমা-টুম-টুম, ঝুম-ঝুমা-ঝুম-ঝুম, গাঁয়ের পথে ভীষণ কাদা, আঁধার আকাশ আবার সাদা, বর্ষাকালের ছবি, অনেক রকম দৃশ্য দেখে পদ্য লেখেন কবি। শিশুতোষগ্রন্থ চিরিপ চিরিপ কিরপ কিরপ’ ছড়াগ্রন্থে আমরা অগাধ দেশপ্রেম ও প্রকৃতি সচেতন একজন কবিকে দেখতে পাই- নতুন পাতা নতুন কুঁড়ি নতুন নতুন ফুল, গোলাপ-বেলি-হাসনা-হেনা দোলছে দোদুল দুল,শিমুল জবা কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটেছে গাছে,বাতাস এলে তালবেতালে ফুলগুলো সব নাচে। তাছাড়া ফুলের ছড়া, ফলের ছড়া, মাছের ছড়া, পাখির ছড়া, পিঠার ছড়া, বিড়ালের বাচ্চা, গরীবের শীত, সত্যের চাষ, শরৎ এলো তাই এমন নানা নামের লেখা থেকে অনুমান করা যায় যে তার কবিতায় বিষয় বৈচিত্রতার ছোঁয়া কম লাগেনি। যেমন-‘যুদ্ধ ফেরত বীর বলে মা সব হারিয়ে এলাম, আব্বু এবং বোনকে দিয়ে স্বাধীনতা পেলাম, আজ থেকে মা লাখ বোন আমার, দৃপ্ত পায়ে চলবে,যুগের পরে যুগের মানুষ এই ইতিহাস বলবে, মাগো এই ইতিহাস বলবে।’ (শুভ্র ভুলের নাও, কাব্যগ্রন্থ)। এই লেখাটিতে কবির দেশপ্রেমের চেতনা মূর্ত হয়েছে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার মতো। অপরূপ প্রকৃতির বর্ণনা তার কবিতায় যেন জয়নুলের চিত্রকল্পের প্রকাশ পায়। তার উদাহরণ আমরা এ কবিতায় এভাবে দেখতে পাই- ‘গ্রীষ্ম শেষে মেঘের বাদাম বর্ষা এসে উড়ায়,নানান রঙের পাল দেখে মন আনন্দে খুব জুড়ায়, শরৎ কালে নদীর পারে, শুভ্রকাশের সারে সারে ওরে সাদা পাল, শিমুল জবা কৃষ্ণচূড়ার পাল টুকটুক লাল,স্বর্ণালী ধান সোনার বাদাম হেমন্তী গায় গীত, ঘোর কুয়াশার বাদাম উড়ে আসছে এবার শীত, নীল সবুজের পাল উড়ে গাঁয়,ঋতুর রাজা বসন্ত চায় রোদের বাদাম তুলে,নীল সবুজের পাল ভরে যায় নানান ফুলে ফুলে, আমার এদেশ নীল সবুজের পাল উড়ানো নাও,সকল দেশের রানী- মাকে যাও না দেখে যাও।’(নীল সবুজের পাল, কাব্যগ্রন্থ)।
তদুপরি সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ কবি জালাল খান ইউসুফী সাহিত্য সাধনার মধ্যদিয়ে সকল জাতি, সকল গোষ্ঠী, সকল দেশ সকল সময় ও তাঁর কালকে জয় করে নিবেন। বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে পুঁথির ছন্দে রচিত হয় সম্পাদকীয় মাসিক কাব্যকথা পত্রিকা, আর সেই পত্রিকার সফল সম্পাদক জালাল খান ইউসুফী। পুঁথিসাহিত্যের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র নিজের আলোয় আলোকিত করে চলেছেন আমাদের আধুনিক পুঁথিসাহিত্যের ভুবন। তিনি কবিতা গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি দু’হাতে লিখলেও পাঠক শ্রোতা ইতোমধ্যেই তাঁর নানা সুর ও ছন্দের পুঁথিকে ব্যাপক ভাবে গ্রহণ করেছে, তারই বাস্তব প্রমাণ লেখা ও পড়ার কারণে তাঁর পাঠকশ্রোতারা তাকে পুঁথিস্রাট উপাধিতে ভূষিত করেছে। শুধু তাই নয়- উদার দিগন্ত সাহিত্য সংসদ ও পাঠাগার নামে একটি সরকার অনুমোদিত সাহিত্য সংগঠন সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে এক বিশাল জনসমুদ্রে তাঁকে ভূষিত করে পুঁথিসম্রাট উপাধিতে। তারই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুঁথির আশেক শ্রোতারা তাকে একের পর এক পুঁথিসম্রাট অভিধায় ভূষিত করে সংবর্ধিত করে যাচ্ছে। পাঠক-শ্রোতার মননের আলোক আরো দ্যুতিময় করতে, আধুনিক বাংলা পুঁথিসাহিত্যের বিস্তৃতি বৃদ্ধির জন্য আমাদেরও পুঁথিসম্রাট জালাল খান ইউসুফীর সহযোগী হতে হবে। সহযোগী হতে হবে পুঁথিসাহিত্যের সরব অগ্র্রযাত্রার। তবেই আমরা পেতে পারি পুঁথিসাহিত্যের আধুনিক একটি উজ্জ্বল ভুবন।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *