বিএনপি নেতা আ ফ ম কামাল খুনের ঘটনা পরিকল্পিত:সম্রাটের নেতৃতে কামাল খুনের মিশন

নিউজ ডেস্ক :: সিলেটের বিএনপি নেতা আ ফ ম কামাল খুনের ঘটনা পরিকল্পিত। পূর্বের দ্বন্দ্বের জের ধরে ছাত্রলীগ কর্মী সম্রাটের নেতৃত্বে খুনের মিশন চালানো হয়। খুনের ঘটনার পর হামলাকারীরা আম্বরখানা বড়বাজারে গলির প্রধান সড়ক ধরে পালিয়ে যায়। এমনটি জানিয়েছে সিলেটের পুলিশ। এ ঘটনার পর রাতে ওই এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও খুনিদের ধরা সম্ভব হয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বড়বাজার থেকে বেরিয়ে প্রধান সড়কে আসার পর ওরা আম্বরখানা অভিমুখে চলে যায়। ঘটনার বহুমুখিতা রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে এ নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য মিলছে। রোববার রাতে এ নিয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। রাতে এ নিয়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে নগরে। তবে সিলেটের পুলিশ বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে দেখছে না। এ কারণে খুনের ঘটনার পরপরই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আম্বরখানা বড়বাজার এলাকায় যান। সেখানে তারা সিসিটিভি’র ফুটেজ সংগ্রহ করেন। আর সেখান থেকে তারা খুনিদের চিহ্নিত করতে পেরেছেন।

তবে- ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। সিলেট নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা গতকাল বিকালে সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন- সম্রাটের নেতৃত্বে শাকিল, রাজু সহ ৫-৬ জন সন্ত্রাসী এ খুনের মিশনে অংশ নেয়। তারা পরিকল্পনা করে এই খুনের ঘটনা ঘটায়। ঘটনার সময় বিএনপি নেতা আফম কামাল ড্রাইভিং সিটে ছিলেন। এই অবস্থায়ই তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করা হয়। মাত্র দু’তিন মিনিটে ঘটনা ঘটিয়ে তারা চলে যায়। আর খুনিরা চলে যাওয়ার পরপরই প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে হামলার বিষয়টি প্রকাশ হয়। ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন- ঘটনার পর হামলাকারীদের কেউ সিলেট শহর ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গেছে। তাদের ধরতে পুলিশের কয়েকটি টিম কাজ করছে। সিসিটিভি’র ফুটেজ দেখে ওদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

তবে- খুব শিগগিরই খুনিরা গ্রেপ্তার হবে বলে জানান- ওই কর্মকর্তারা। এয়ারপোর্ট থানার ওসি খান মো. মাইনুল জাকির জানিয়েছেন- জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। আফম কামালের সঙ্গে হামলাকারীদের পূর্বের শত্রুতা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নানা অনুসন্ধানে এরই মধ্যে হামলাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি। আফম কামাল সিলেট জেলা বিএনপি’র পরিচিত মুখ। তিনি জেলা বিএনপি’র সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক। গত কাউন্সিলে জেলা বিএনপি’র সম্মেলনে কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। সিলেট শহরতলীর জালালাবাদ ইউনিয়নের আলীর গাঁওয়ে তার বাড়ি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নগরীর সুবিদবাজারে বসবাস করছিলেন। নগরের আম্বরখানায় তার একটি ট্রাভেলস ব্যবসা রয়েছে। হামলাকারী যুবকদের নিয়মিত অবস্থান আম্বরখানাতেই। স্টুডেন্ট ভিসার টাকাকে কেন্দ্র করে অক্টোবরের শেষদিকে ছাত্রলীগ কর্মী আজিজুর রহমান সম্রাট ও তার দলবলের সঙ্গে বিরোধ বাধে আফম কামালের। এ নিয়ে আম্বরখানা এলাকায় ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়াও হয়েছিল। এ ঘটনার পর আজিজুর রহমান সম্রাটের পক্ষ থেকে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের রয়েছে। এ মামলার আসামি হচ্ছেন বিএনপি নেতা আফম কামাল। এ ঘটনার জের ধরে চৌকিদেখি এলাকায় বিএনপি’র আড্ডাস্থলের আশপাশে কয়েকদিন আগে হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলীগের ওই কর্মীরা। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ছিল। এ ঘটনার জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের ডিসি (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ। তিনি গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। এরই মধ্যে আসামিদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। আম্বরখানা এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- আজিজুর রহমান সম্রাটের নেতৃত্বে আম্বরখানা পয়েন্ট সংলগ্ন এলাকায় ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ রয়েছে। ওই গ্রুপের টিম লিডার সম্রাট নিজেই। তারা আম্বরখানা এলাকার নানা বিষয়ে সম্প্রতি জড়িত হয়ে পড়ে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা ছাত্রলীগের কর্মীরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। আওয়ামী লীগের এক নেতার অনুসারী হিসেবে সে নিজেকে জাহির করে। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে যে নেতাদের ছবি ব্যবহার করে আম্বরখানা এলাকায় পোস্টারিং করে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে সম্রাট ছিল ছাত্রদলকর্মী। সরকার বদলের পরপরই সে দলও বদল করে ফেলে। এরপর রাজনৈতিক নেতাদের শেল্টার নিয়ে এখন আম্বরখানা এলাকার ত্রাসে পরিণত হয়েছে সম্রাট। শুধু আফম কামাল নয়, আর অনেকেরই সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে। এসব বিরোধের কারণে তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন সবাই। এখন তার সঙ্গে এলাকার সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারীরা চলাচল করে। এদিকে- গতকাল দুপুরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত বিএনপি নেতা আফম কামালের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এরপর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওখানে উপস্থিত ছিলেন সিলেট জেলা বিএনপি’র সিনিয়র নেতারা। এ সময় জেলা বিএনপি’র সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী জানান- আফম কামাল খুনের ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্মীরা গ্রেপ্তার না হলে আগামী ২০শে ডিসেম্বর সিলেট বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। প্রয়োজনে বিএনপি’র তরফ থেকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া আফম কামালের মৃত্যুতে আগামী তিনদিন তারা শোক কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানান তিনি।

কামালের শরীরে ২৩টি আঘাতের চিহ্ন: কিছুটা অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকা হওয়ায় প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রথমেই বুঝতে পারেননি ঘটনা। তাদের ধারণা হয়েছিল একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়েছেন প্রাইভেটকার। এতে মোটরসাইকেল আরোহীরা ছিটকে পড়ে যান। এ কারণে প্রত্যক্ষদর্শীরা এগিয়ে এসে মোটরসাইকেলটিকে উদ্ধার করেন। আর ওই সময়েই ঘাতকরা প্রাইভেট কারের ভেতরে ঢুকে সিলেটের বিএনপি নেতা আফম কামালকে কোপায়।

এদিকে- মোটরসাইকেল চলে যাওয়ার পর প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেন প্রাইভেটকারটি চলছে না। এ সময় তারা এগিয়ে দেখেন কারের ভেতরে গোঙাচ্ছেন আফম কামাল। তারা ধরাধরি করে কামালকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ঘটনার সময়কাল ২ থেকে ৩ মিনিট। ওই সময়ের মধ্যে তারা বিএনপি নেতা আফম কামালকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে হামলাকারীরা দ্রুত চলে যায়। সোমবার দুপুরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহত বিএনপি নেতা আফম কামালের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তকালে বিএনপি নেতা আফম কামালের শরীরে ২৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রায় সবক’টি আঘাতের চিহ্নই গুরুতর। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন বিএনপি নেতা আফম কামাল। কামালের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শামসুল ইসলাম সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন- ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা গেছেন আফম কামাল। তার শরীরের বাম পাশেই সব আঘাতের চিহ্ন। তিনি জানান- বাম হাত, বুকের বাম পাশ, বামপাশের কাঁধের নিচ, পায়ের উরুতে এসব আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

এদিকে- রোববার রাতে সিলেট নগরীতে নাশকতার অভিযোগে পুলিশ দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদেরকে থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ।

জেলা ও মহানগর বিএনপি’র বিবৃতি: সিলেট ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের হাতে সিলেট জেলা বিএনপি’র সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক আফম কামাল হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপি’র সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, সিলেট মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকী, জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী ও সিলেট মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব মিফতাহ সিদ্দিকী। সোমবার বিএনপি নেতৃবৃন্দ একযৌথ বিবৃতিতে বলেন, রাজনৈতিক সমপ্রীতি এই শহরে সন্ত্রাসী চক্রটি নিরপরাধ বিএনপি নেতা আফম কামাল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সিলেট শহর আজ আতঙ্কিত ও নিস্তব্ধ। আমরা অবিলম্বে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের ও ঘটনার নেপথ্যে থাকা গডফাদারদের গ্রেপ্তার করে সিলেটের রাজনৈতিক সমপ্রীতিকে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাই।

এই হত্যাকাণ্ডের পর গতকাল রাতে যেসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে এসব ঘটনার সঙ্গে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি কিংবা অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের জড়িয়ে যেসব বক্তব্য এসেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *