ঘুস নেওয়ার প্রমাণ মিললেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা

 নিউজ ডেস্ক::  রাজশাহী শিক্ষা অঞ্চলের দুই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার (ইউএসইও) বিরুদ্ধে ঘুস বাণিজ্যের গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ভুক্তভোগী শিক্ষক কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠান প্রধানরা নিজ নিজ এলাকার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও  রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বরাবর পৃথক লিখিত অভিযোগ দেন। পরে তদন্তে নাচোল মাধ্যমিক শিক্ষা  কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণসহ আনীত সকল অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। অন্যদিকে আরেক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

আলোচিত দুই শিক্ষা কর্মকর্তা হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আ ফ ম হাসান ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দুলাল আমল। এর মধ্যে নাচোল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে মর্মে সম্প্রতি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রশিদ। তদন্ত কর্মকর্তা আ ফ ম হাসানের বিরুদ্ধে ঘুস বাণিজ্যের তীব্রতা বিবেচনায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও দিয়েছেন।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী চাঁপাইনাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আ ফ ম হাসানের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ বরাবর গত এপ্রিলে গুরুতর ঘুস বাণিজ্যের লিখিত অভিযোগ করেন উপজেলার ১৮টি স্কুল ও মাদ্রাসার ভুক্তভোগী শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার অভিযোগগুলো গ্রহণ করে রাজশাহী অঞ্চল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কাছে পাঠিয়ে দেন। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে। তদন্ত কর্মকর্তা ১২ থেকে ১৪ মে পর্যন্ত সময়ে সরেজমিন তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। গত সপ্তাহে সুপারিশসহ তিনি বিস্তৃত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

অভিযোগ অনুযায়ী সম্প্রতি এনটিআরসি থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত বেশ কিছু শিক্ষককে নাচোল উপজেলার বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় নিয়োগের জন্য পাঠানো হয়। এসব শিক্ষক যথারীতি নিয়োগ লাভ করে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে যোগ দেন। যোগদান করেই তারা এমিপওভুক্তির জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে অনলাইনে এমপিও ফাইল পাঠান। কিন্তু নাচোল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হাসান জমাকৃত ফাইলগুলো জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে অনলাইনে পাঠানোর জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে ফাইল আটকে দেওয়ার হুমকি দিয়ে হাসান কোনো কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে ৯০ হাজার এক লাখ থেকে দুই-আড়াই লাখ পর্যন্ত আদায় করেন।

ভুক্তভোগী শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, সরকারের চলমান এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী শুধুমাত্র অনলাইনে এমপিও ফাইল পাঠানোর নিয়ম আছে। কিন্তু হাসান প্রত্যেককে চাপ দিয়ে হার্ড কপি দিতেও বাধ্য করেছেন। এর মধ্যে টাকা না পেয়ে অনেকের এমপিও ফাইল যেমন আটকেছেন তেমনি এমপিও আবেদন বাতিলও করেছেন। পরে টাকা দিয়ে ফাইল ছাড়াতে হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী নাচোলের সোনাইচন্ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান, তার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন নতুন শিক্ষকের এমপিও অনলাইনে পাঠালে মাধ্যমিক অফিসার ৪০ হাজার টাকা ঘুস দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকার করলে কর্মকর্তা প্রধান শিক্ষককে বলেন টাকা না দিলে এমপিও ফাইল যাবে না। অফিসার আরও বলেন, কোনো না কোনো ভুল আমি ঠিকই খুঁজে বের করব। আমি টাকা ছাড়া কাজ করি না।

নাচোল বেগম মহসীন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ইসাহাক আলি তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান, তার প্রতিষ্ঠানের তিন শিক্ষকের এমপিও আবেদন করা হলে হাসান এক লাখ টাকা করে দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত ৯৮ হাজার টাকা ঘুস নেন। একই মাদ্রাসার ৮ শিক্ষকের উচ্চতর বেতন স্কেলের সুপারিশ পাঠাতে ২ লাখ টাকা ঘুস আদায় করেন হাসান। একই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিষয়ে নিয়োগকৃত শিক্ষকের এমপিও আবেদন গ্রহণের জন্য তিনি নেন আরও ১০ হাজার ঘুস।

ঝলঝলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রুহুল আমিন জানান, শিক্ষা অফিসার হাসান তার প্রতিষ্ঠানের এমপিও আবেদন অগ্রায়নের জন্য ৬০ হাজার টাকা নিয়েছেন। তিনি বাধ্য হয়েই এই টাকা দিয়েছেন।

নাচোল উপজেলার রাজবাড়ী হাইস্কুলের ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক সোহেল রানা, ভাতসা স্কুলের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক সাজিয়া আফরিন, সোনাইচন্ডি হাইস্কুলের শিক্ষক আব্দুল বাসিরের কাছে হাসান লাখ টাকা করে দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকার করলে গত ১৪ এপ্রিল তাদের এমপিও আবেদন বাতিল করেন। পরে টাকা দিয়ে তার ফাইল অগ্রগামী করা হয়। এই তিন শিক্ষক উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন।

জেলা শিক্ষা অফিসার তদন্ত প্রতিবেদনের মতামত ও  মন্তব্যে বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সরবরাহকৃত নথিপত্র, লিখিত সাক্ষ্যপত্র ও মৌখিক জবানবন্দিতে সন্দেহাতীতভাবে নাচোল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অধিকাংশ অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আ ফ ম হাসান নানা ছলছুতায় শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছ থেকে অকাতরে ঘুস নিয়েছেন। মতামতে তদন্ত কর্মকর্তা আরও লিখেছেন, নাচোল উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছ থেকে অভিযোগে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাসানকে নিয়ে যৌথ বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে হাসান ঘুস নেওয়ার কথা স্বীকার করে আর ঘুস নেবেন না বলে অঙ্গীকার করেন। তারপরও তার ঘুস বাণিজ্য থামেনি। তাকে দেশের দুর্গম কোনো এলাকা বদলি করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নাচোল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আ ফ ম হাসান  বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে সব কাগজপত্র ও প্রমাণপত্র দিয়েছেন। যাদের এমপিও আবেদন বাতিল হয়েছে কাগজপত্রে ত্রুটি থাকার কারণে হয়েছে। পরে কাগজপত্র ঠিক হলে এমপিও ফাইল অগ্রগামী করেছেন। তিনি ঘুস নেননি।

অন্যদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দুলাল আলমের বিরুদ্ধেও অনুরূপ অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. শারমিন ফেরদৌস চৌধুরী।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *