ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট নেই তবু দাম লাগামহীন

সিলেট নিউজ টাইমস্ ডেস্ক:: দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট না থাকলেও দাম বাড়ছে দফায় দফায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তি। এর প্রভাবে দেশে দাম বাড়ছে। কিন্তু দেশে এ মুহূর্তে পর্যাপ্ত তেলের মজুত আছে। অন্তত রমজান মাস পর্যন্ত সংকট তৈরি হওয়ার তেমন কোনো আশঙ্কাও নেই। তবে তাদের অভিযোগ, কোম্পানি ও পরিবেশকরা মিলে বাজারে কৃত্রিমভাবে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি করেছে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ৩৬ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল নিয়ে তিনটি জাহাজ অবস্থান করছে। এছাড়া পাইপলাইনে রয়েছে ভোজ্যতেল বোঝাই আরও কয়েকটি জাহাজ।

ব্যবসায়ীরা জানান, রমজানের পরে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা এ মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার মধ্যে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে এ মুহূর্তে সাহস পাচ্ছেন না আমদানিকারকদের কেউ কেউ। আবার লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে ভোজ্যতেলের এলসি খুলছেন। বেশি দামে তেল কিনে দেশের বাজারে ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিয়ে তারা চিন্তিত। এখন যেসব এলসি হচ্ছে, সেই তেল দেশে আসবে এক থেকে দেড় মাস পর। যদি এই সময়ে এলসি কমে যায়, তাহলে এক থেকে দেড় মাস পরে সংকট দেখা দিতে পারে। অবশ্য ব্যবসায়ীরা এটাও বলছেন, আমদানি মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশীয় বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণ করা হলে আমদানিতে সংকট নাও দেখা দিতে পারে। ব্যুরোদের পাঠানো খবর-

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, বন্দরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল বোঝাই তিনটি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে সুমাত্রা পাম জাহাজে ১১ হাজার ৯৯৯ টন, সান জিনে ১২ হাজার টন ও পিভিটি নেপচুনে ১২ হাজার টন ভোজ্যতেল রয়েছে। বন্দর সূত্র জানায়, এক সপ্তাহের মধ্যে আরও কয়েকটি জাহাজভোজ্য তেল নিয়ে ভিড়তে পারে।

দেশে ভোজ্যতেল আমদানি ও বিপণনে জড়িতদের দাবি, এক-দেড় মাস আগেও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৪শ মার্কিন ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৮শ থেকে ১৯শ ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শুধু তেল নয়, গমসহ প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দামই বিশ্বব্যাপী বেড়েছে।

ভোজ্যতেলের অন্যতম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক তারিক আহমেদ বলেন, ‘প্রতি টন সয়াবিন তেলের এলসি এখন প্রায় ১৯শ ডলারে খুলতে হচ্ছে। এই দামে তেল কিনে আনার পর বর্তমানে সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, সেই অনুযায়ী হিসাব করলে ১৪শ ডলারের মতো বিক্রি করতে হবে। যদি মূল্য পুনর্নির্ধারণ না হয়, তাহলে বর্তমান আমদানি মূল্য অনুযায়ী প্রতি টনে আমদানিকারকদের প্রায় ৫শ ডলার গচ্ছা দিতে হবে। এটা বড় লোকসান। এই অস্থিরতার মধ্যেও আমরা সাহস করে দু-একদিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের নতুন এলসি করতে যাচ্ছি। যার দাম টনপ্রতি পড়ছে ১৮৭৯ ডলার। প্রতিবেশী দেশ ভারতের আমদানিকারকরা ১৯শ ডলারে সয়াবিন তেল আমদানি করে কিছু লাভ করছেন বলে শুনছি। সেক্ষেত্রে আমাদের মনে লোকসানের শঙ্কা।

তিনি জানান, দেশে তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। রমজান পর্যন্ত সংকট হবে না। তাবে রমজানের পরে কী হয়, বলা যাচ্ছে না। পুরো বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। হয়তো একটা পর্যায়ে তেলের বাজারে অস্থিরতা কেটে যাবে।

চট্টগ্রামে খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন প্রতি কেজি ২০০ টাকায় এবং খোলা ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতি ৫ লিটারের বোতল ৭৯০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এ বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক মাসে পাইকারিতে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৭শ থেকে ৮শ টাকা। আর পামঅয়েল বেড়েছে ৫শ টাকা। প্রতি মন সয়াবিন পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ টাকায়, যা খুচরায় ৭ হাজার ২০০ টাকা। প্রতি মন পাম অয়েল পাইকারিতে ৫ হাজার ৮০০ এবং খুচরায় ৬ হাজার টাকা, পাম সুপার পাইকারিতে ৬ হাজার ১০০ ও খুচরায় ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘তেলের কোনো সংকট নেই। সয়াবিনের সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে। তবে পাম অয়েলের সরবরাহ কিছুটা কম। শীতকালে এই তেল জমে যায় বলে এলসি কম হয়। এখন গরম পড়তে শুরু করায় এলসি হচ্ছে। সামনে প্রচুর পামঅয়েল আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন সয়াবিনের চেয়েও বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের দাম বেশি বাড়ছে।’ তিনি জানান, চাকতাই-খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন প্রায় ২০০ ট্রাক তেল (প্রতি ট্রাকে ৬ হাজার ১২০ লিটার) বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ৫০ ট্রাক সয়াবনি এবং ১৫০ ট্রাক পামঅয়েল ও পাম সুপার।

 

খাতুনগঞ্জের পাইকাররা জানান, দেশে টিকে গ্রুপ, সিটি, মেঘনা, বসুন্ধরা, এসআলমসহ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে ভোজ্যতেল আমদানি করে। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে নিয়ে বাজারজাত করেন। তারা আরও জানান, খুচরা পর্যায়ে কেউ কেউ তেল মজুত করে রাখছেন। সে জন্য খোলা তেলের একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। তবে পাইকারি বাজারে থেকে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।

রাজশাহী : মহানগরীতে বেড়েই চলেছে সয়াবিন তেলের দাম। পাশাপাশি বাজারে দেখা দিয়েছে নিত্যপণ্যটির কৃত্রিম সংকট। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অব্যাহত অভিযানের ভেতরেও সয়াবিন তেলের বাড়তি দাম আদায় করছে এক শ্রেণির দোকানি। নগরীর সাহেব বাজার, শিরোইল কাঁচাবাজার, কাজলা বাজার ও হড়গ্রাম কোর্টবাজার এলাকা ঘুরে সোমাবার দেখা গেছে, বাজারের অধিকাংশ দোকানে নেই বোতলজাত সয়াবিন তেল। তবে কোনো কোনো দোকানে মিলছে খোলা তেল। দোকানগুলোতে ৫০০ গ্রাম ও ১ লিটারের কয়েকটি বোতল থাকলেও নেই ৫, ৩ ও ২ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল। দোকানিরা বলছেন, সরবরাহ নেই। তবে ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু ব্যবসায়ী সয়াবিন তেলের মজুত করেছে। বড় বোতল ভেঙে কনটেইনারে রেখে খোলা বিক্রি করছে বাড়তি দামে।

ব্যবসায়ীরা জানান, গত দুসপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে সয়াবিন তেলের দাম বাড়তির দিকে। পরিবেশকরা তাদের বড় বোতল দিচ্ছে না। বলছে, উৎপাদন কম। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহীর কোনো বাজারের দোকানে ৫ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল নেই। যা ছিল তা অনেক আগেই সবাই কেটে তা খোলা তেল হিসাবে বিক্রি করছে। খোলা তেলে লাভ বেশি।

কারণ হিসাবে তারা আরও জানান, বাজারে বোতলজাত তেলের মূল্য ১৬৫ টাকা লিটার। অন্যদিকে খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা লিটারে। এ দাম আরও বাড়তে পারে বলেও জানিয়েছেন দোকানিরা। মুদি দোকান, সুপার স্টোর ও বাজারের বড় বড় মুদি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, তেল কোম্পানিকে চাহিদা দিয়েও সয়াবিনের বড় বোতল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খোলা তেলের মজুত রয়েছে ঠিকই। কিন্তু বোতলজাত তেলের চাইতে দাম তুলনামূলকভাবে লিটারে ৮ থেকে ১০ টাকা বেশি বিক্রি করছেন খোলা তেল।

নগরীর কাজলা মহল্লার নূপুর সেখ বলেন, নাস্তা তৈরির সময় তেল শেষ হয়েছে আজ সকালে। তাই বাড়ির পাশের দোকানগুলোতে তেল কিনতে গেলে দোকানি সাফ জানিয়ে দিলেন বোতলের তেল নেই। আশপাশের কয়েকটি দোকানে গিয়েও বোতলজাত সয়াবিন পাওয়া যায়নি।

নগরীর সাগরপাড়া বাসিন্দা গোলাম রাব্বানী বলেন, বাজার থেকে সয়াবিন তেল গায়েব। রাতারাতি এতো তেল গেল কোথায়। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ সংসার চালাবে কীভাবে। আর বাঁচবে কি করে।

সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট সম্পর্কে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হাসান আল মারুফ জানান, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে এ ধরনের নোংরা কাজগুলো করছেন। তারা তেলের মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। তেলের দাম বৃদ্ধি ও মজুতের বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *