বিলাসবহুল ৩০ গাড়ি অঙ্গীকারনামায় ছাড়

সিলেট নিউজ টাইমস্ ডেস্ক:: শুল্ক গোয়েন্দার জোর আপত্তি সত্ত্বেও অঙ্গীকারনামায় ৩০টি বিলাসবহুল নতুন (ব্র্যান্ড নিউ) জিপ গাড়ি খালাস করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। আন্ডার ইনভয়েস (ক্রয়মূল্য কম দেখানো) এর প্রমাণ পাওয়ায় ওই চালান খালাসে আপত্তি জানায় সংস্থাটি।

কিন্তু সেটি আমলে না নিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক (ব্যবসা নিবন্ধন নম্বর) অবমুক্ত করতে বারবার তাগাদা দেন। একপর্যায়ে গাড়িগুলো খালাসের অনুমতি দেয় কাস্টমস। পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকলেও কাস্টমস কমিশনার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেননি। উল্টো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কার্যপরিধি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে আমদানিকারকরা বলছেন,কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম সৎ ও নিষ্ঠাবান হিসেবে সব মহলে পরিচিত। পণ্য খালাসে কখনও অনিয়ম ও গাফিলতিকে প্রশ্রয় দেন না। মিথ্যা ঘোষণার প্রমাণ পেলেই জরিমানা করেন।

কিন্তু তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এতবড় অনিয়ম মানা যায় না। কমিশনারের কড়াকড়ির কারণে যেখানে শিল্পে ব্যবহৃত পণ্য বা মূলধনী যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে ব্যাংক গ্যারান্টিও আমলে নেয়া হয় না। সেখানে অঙ্গীকারনামা নিয়ে গাড়ি ছাড় করায় রীতিমতো বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। কারণ গাড়ি উচ্চ শুল্কযুক্ত পণ্য। এক্ষেত্রে অঙ্গীকারনামা নিয়ে কাস্টমস ওই আমদানিকারককে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এ ধরনের বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। আইনের প্রয়োগ সবার ক্ষেত্রেই সমান হওয়া উচিত।

এনবিআরের সাবেক শুল্ক নীতির সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় অঙ্গীকারনামা নিয়ে গাড়ি ছাড় করা ঠিক হয়নি। সাময়িক শুল্কায়ন করা হলে ব্যাংক গ্যারান্টি বা অন্য গ্যারান্টি নিয়ে গাড়ি ছাড় করলে রাজস্ব সুরক্ষা হতো।

তিনি আরও বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা আপত্তির পরও কাস্টমস কেন তা আমলে নেয়নি তা বোধগম্য নয়। উচিত ছিল, দু’পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে গাড়ির শুল্কায়ন নির্ধারণ করা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে র‌্যাংকন ব্রিটিশ মটরস প্রথমবারের মতো চায়না থেকে এমজি ব্র্যান্ডের ৩০টি জিপ আমদানি করে। ৩০ ডিসেম্বর গাড়ি খালাসে ‘বিল অব এন্ট্রি’ জমা দেয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এসব গাড়ি খালাসে পদে পদে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আর এ কাজে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। শুরুতেই আমদানি করা ‘ব্র্যান্ড নিউ’ গাড়ির মূল্য ঘোষণা দেয়া হয় ৫ হাজার ৫১৫ ডলার (৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫৬১ টাকা)। কাস্টমস সেই গাড়ির শুল্কায়ন করে ৫ হাজার ৬৩৫ ডলারে (৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৩৫ টাকায়)।

এত কম দামে নতুন গাড়ি আগে কখনও শুল্কায়নের তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া নতুন মডেলের গাড়ি আমদানি করা হলে কাস্টমসের টেকনিক্যাল কমিটির সহায়তায় ‘সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি’ ও ‘ইগনিশন সিস্টেম’ পরীক্ষা করার রেওয়াজ আছে। দীর্ঘদিন ধরে এ পদ্ধতিতেই নতুন গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আলোচ্য চালানের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। আমদানিকারকের ঘোষিত বর্ণনা অনুযায়ীই চালান খালাসের প্রস্তুতি নেয়া হয়।

পুরো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে শুল্ক গোয়েন্দা থেকে কাস্টমসকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, গাড়ির আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কাস্টমস শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণে যথাযথভাবে শুল্কায়ন বিধিমালা অনুসরণ করেনি। অবরোহী (ডিডাক্টিভ) পদ্ধতিতে অনুসরণ করলে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য দাঁড়ায় ১১ হাজার ১৩১ ডলার (৯ লাখ ৪৩ হাজার ৬৮৬ টাকা)। কারণ প্রতিষ্ঠান নিজেরাই ভ্যাট দফতরে এবং পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায় এসব গাড়ি বিক্রি করছে। এছাড়া এ মডেলের গাড়ি খোদ চায়নাতেই বিক্রি হয় ১৩ হাজার ৭৩৮ ডলারে (১১ লাখ ৬৪ হাজার ৭০৭ টাকা)। পাশাপাশি ২০১৫ সালের এনবিআরের নির্দেশনা মতে প্রতিটি গাড়ির এফওবি (জাহাজীকরণ) মূল্য দাঁড়ায় ১১ হাজার ৪০২ ডলার।

এরপর ৩০ জুন শুল্ক গোয়েন্দাকে পাল্টা চিঠি দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপকমিশনার জানান, আমদানিকারক ইঞ্জিনের সিসি নির্ণয়ে কিছু দলিল ও বিআরটিএ থেকে রেজিস্ট্রেশনের যে তথ্য উপস্থাপন করেছে তা থেকে সিসি নির্ণয় সম্পর্কিত ঘোষণা সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়।

তাছাড়া পত্রিকার বিজ্ঞাপনকে ভিত্তি ধরে স্থানীয় বাজার মূল্য নির্ধারণ বিধিসম্মত নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটির পোর্ট চার্জ লাঘবে অঙ্গীকারনামায় বিপরীতে গাড়ি খালাসের প্রস্তাব দেয়। জবাবে ৫ ফেব্রুয়ারি শুল্ক গোয়েন্দা থেকে জানানো হয়, কাস্টমস আইন অনুযায়ী সাময়িক শুল্কায়ন কাস্টমসের এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু অঙ্গীকারনামার ভিত্তিতে সাময়িক শুল্কায়নের আইনগত ভিত্তি নেই।

আলোচ্য ক্ষেত্রে কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দার মধ্যকার শুল্ক-করের পার্থক্যের অর্থ ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে সাময়িক শুল্কায়ন করা যেতে পারে। এর ৫ দিন পর শুল্ক গোয়েন্দার সুপারিশ আমলে না নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, আমদানিকারকের অঙ্গীকারনামা গ্রহণ করা হয়েছে। তাই চালান সিস্টেমে আনলক করার অনুরোধ জানান তিনি।

শুল্কায়নে অনিয়মের পুরো ঘটনা উল্লেখ করে এনবিআরকে চিঠি দেয় শুল্ক গোয়েন্দা। এরই পরিপ্র্রেক্ষিতে এনবিআর শুল্ক গোয়েন্দার আপত্তি সত্ত্বেও কেন সঠিক মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব সুরক্ষা না করে অঙ্গীকারনামা নিয়ে গাড়ি ছাড় করা হল- এর ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দেয়।

মূলত এরপরেই শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমসের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এনবিআরের চিঠির জবাবে কাস্টমস জানায়, ‘একটি অনিষ্পন্ন বিষয়ের গোপনীয় দলিল কর্তৃপক্ষের (কাস্টম হাউস) বিনা অনুমতিতে সংগ্রহ এবং তার ভিত্তিতে অভিযোগ দাখিল কোনোভাবেই আইনানুগ নয়। এটি অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের আওতায় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।’ পাল্টা চিঠিতে এনবিআর কাস্টম কমিশনারকে চিঠির ভাষার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম মঙ্গলবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, গাড়ির প্রকৃত মূল্য নির্ধারণে শুল্ক মূল্যায়নকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তারা যে মূল্য নির্ধারণ করে দেবে, সে অনুযায়ী বাড়তি শুল্ক আদায় করা হবে। শুল্ক গোয়েন্দা শুধু আপত্তি দিয়েছে, কিন্তু চালান কীভাবে ছাড় করা যায় সে ব্যাপারে সুপারিশ করেনি। অনন্যোপায় হয়ে কাস্টমসকে অঙ্গীকারনামায় গাড়ি ছাড় করতে হয়েছে।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তর বলেন, এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম কাস্টম দুটি অনিয়ম করেছে। প্রথমত, তারা শুল্ক গোয়েন্দার আপত্তি বিবেচনায় নেয়নি, উল্টো কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশ করে গাড়িগুলো ছাড় দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, গাড়ি আমদানিতে অর্থ পাচারের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কারণ এত কম মূল্যে জিপ আগে সম্ভবত আমদানি হয়নি। তাই কাস্টমসের বিভাগীয় তদন্তের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে।

গাড়ি আমদানিতে ব্যাপক আন্ডার ইনভয়েসিং : পুরাতন গাড়ি আমদানিকারকরা বলছেন, এত কম মূল্যে জিপ গাড়ি পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না। নতুন গাড়ির শুল্কায়নে বিশাল ফাঁকফোকর থাকায় তার সুযোগ নিচ্ছেন আমদানিকারকরা। মূলত দেশে যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন গাড়ি আমদানি করে তারাই বিদেশে বেনামে কোম্পানি খুলে বা রফতানিকারকদের ‘ম্যানেজ’ করে ইনভয়েস তৈরি করে। নতুন গাড়ি শুল্কায়ন করা হয় ইনভয়েস মূল্যের ওপর।

এক্ষেত্রে সহজেই ইনভয়েসে গাড়ির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো যায়। এ নিয়ে কোনো সংস্থা কখনও প্রশ্ন তোলেনি। আর কাস্টমস প্রশ্ন তুললেও আমদানিকারকদের ঘুরেফিরে একই উত্তর, গাড়ির স্পেসিফিকেশনে পার্থক্য রয়েছে। আদতে তা কতটুকু সঠিক কাস্টমস থেকে যাচাই করা হয় না। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশের গাড়ি, আর বাংলাদেশের আমদানিকৃত একই মডেলের নতুন গাড়ির স্পেসিফিকেশনের কোথায় পার্থক্য আছে তাও স্পষ্ট করা হয় না। এ কায়দায় নতুন গাড়ি আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি ঘটনা ঘটছে।

রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশনড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আবদুল হক বলেন, নতুন গাড়ির আমদানি মূল্য নির্ধারণে চরম বিশৃঙ্খলা রয়েছে। এমনও দেখা গেছে, ৫ বছরের পুরাতন গাড়ির চাইতে নতুন গাড়ি কম মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে এনবিআরকে জানানো হলেও প্রতিকার পাইনি। অভিযোগ করলে উল্টো নানাভাবে পুরাতন গাড়ি আমদানিকারকদের হয়রানি করা হয়। তিনি আরও বলেন, নতুন মডেলের জিপের মূল্য কোনোভাবেই সাড়ে ৫ হাজার ডলার হতে পারে না। এনবিআরের পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ এখানে শুল্ক ফাঁকি দেয়া হচ্ছে তা নয়, অর্থ পাচারও হতে পারে।

ওই ৩০টি গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান র‌্যাংকন ব্রিটিশ মটরসের হেড অব অপারেশন মাশনূর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গাড়ির আমদানি মূল্য ঠিক আছে। তারপরও শুল্ক গোয়েন্দা আপত্তি জানানোয় বিষয়টি অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে। এখন কাস্টমসের অন্য একটি গাড়ির মূল্য নির্ধারণে কাজ করছে। তারা গাড়ির যেই মূল্য নির্ধারণ করে দেবে, সে অনুযায়ী পরে শুল্ক পরিশোধ করে দেয়া হবে।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *