প্রত্যাবাসন আতঙ্কে আত্মগোপনে রোহিঙ্গারা, আত্মহত্যার চেষ্টা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হতে পারে এমন আশঙ্কায় কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচ্ছেন, অনেকে আত্মগোপনও করছেন। কেউ কেউ আবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন।

বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান এ তথ্য জানিয়েছে।

আগামী বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের কথা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে।

প্রথম ধাপে চার হাজার রোহিঙ্গার নাম প্রত্যাবাসন তালিকায় রাখা হয়েছে। তাদের সম্মতি ছাড়াই ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলে অধিকাংশ রোহিঙ্গার মত। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাচ্ছেন না।

জামতলী শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন নূর ইসলাম। তিনি বলেন, রাখাইনে ফেরত পাঠাতে কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকজনকে বারবার উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এতে তারা স্বস্তিবোধ করছেন না; বরং ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অন্য শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে গেছেন।

ক্রাইসিস গ্রুপের ভাষ্যেও একই বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। আশ্রয় শিবিরের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তারা জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসনের ভয়ে অনেক শরণার্থী আত্মগোপন করেছেন।

এমনকি এর আগে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম দেখার পর রোহিঙ্গারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে দুটি ঘটনার প্রতিবেদন ছেপেছে গার্ডিয়ান।

গত বছরের আগস্টের শেষ দিকে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযানের পর সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আগে থেকে আরও চার লাখ বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।

এসব রোহিঙ্গার বর্ণনায় হত্যা, ধর্ষণ, অঙ্গহানি, জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা, বসতবাড়ি ভস্মীভূত করে দেয়াসহ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিভৎস হামলা কথা উঠে এসেছে।

দেশটিতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর এ সহিংসতা, ধরপাকড় ও বিধিনিষেধকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রধান সম্প্রতি বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এখনও চলছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে সেখানে রাখাইন জাতীয়বাদীরা বিক্ষোভ করেছেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, এটি প্রত্যাবাসনকে সহজ করে তুলবে না। সোমবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের সম্মতির আগে তাদের রাখাইনে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসার সুযোগ দেয়া উচিত।

সত্যি ঘটনা হচ্ছে-যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরে যাবেন, তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ থাকবে না। গত বছরের আগস্টে তাদের যেভাবে নিপীড়নমূলক নিষেধাজ্ঞার ভেতর থাকতে হয়েছিল, এখনও তাদের একই অবস্থার ভেতর গিয়ে পড়তে হবে।

মিয়ানমারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী উইন মিইয়াট আই বলেন, ফেরত আসা রোহিঙ্গারা কেবল মংডু শহরতলিতে বিধিনিষেধের ভেতর থাকবেন।

তিনি বলেন, ফেরত আসা রোহিঙ্গাদের হ্লা কুয়াং আশ্রয় শিবিরে রাখা হবে। সেখানে তারা এক রাত অবস্থান করবেন। পরে তাদের মংডুতে ফেরত পাঠানো হবে।

উইন মিইয়াট বলেন, গৃহহীনদের জন্য বসতবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। যাদের কোনো বসতবাড়ি নেই, তাদের অস্থায়ী আবাসস্থলে রাখা হবে। তাদের নিজস্ব বাড়ির আশপাশেই হবে এ অস্থায়ী আবাসস্থল।

‘নিজেদের বাড়িঘর নির্মাণের কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার অনুমতি থাকবে রোহিঙ্গাদের। এ ক্ষেত্রে তারা শ্রমের মূল্য পাবেন। যদি তারা সরকারি কর্মসূচিতে থাকতে চান, তবে বসতবাড়ি নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত তারা হ্লা পো কুয়াং আশ্রয় শিবিরে থাকতে পারবেন।’

ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের প্রস্তুত করতে কক্সবাজারে দুটি ক্যাম্প নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। দৈনিক গড়ে ১৫০ রোহিঙ্গাকে প্রস্তুত করে এখান থেকে নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

সোমবার বাংলাদেশের শরণার্থী কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম গার্ডিয়ানকে বলেন, বৃহস্পতিবারই প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত। কিন্তু ইউএনএইচসিআর বলেছে, সেখানে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনাগত জটিলতা রয়েছে।

কিন্তু যখন বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলছেন, স্বেচ্ছায়ই সব প্রত্যাবাসন ঘটবে। কিন্তু সেখানে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে-ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের চাপ দেয়া হচ্ছে। আশ্রয় শিবিরের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের বলছেন, তাদের ফিরে যেতে হবে।

স্ত্রী ও ছয় সন্তান নিয়ে জামতলী আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন মোহাম্মদ ইসমাইল। প্রত্যাবাসন তালিকায় তাদের পুরো পরিবারের নাম রয়েছে বলে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের এক নেতা তাদের জানিয়েছেন।

গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, তাদের বলেছি-বর্তমান পরিস্থিতিতে বার্মায় ফিরে যেতে আমি ভয় পাচ্ছি। কিন্তু তারা বলেছেন- এখানে পালানোর কোনো সুযোগ নেই। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।

সীমান্ত পাড়ি দিতে বাংলাদেশের পুলিশ তাদের ওপর বলপ্রয়োগ করতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

তিনি বলেন, যদি মিয়ানমারে ফিরে যেতে তারা আমাদের প্রতি জোর করে, তা হলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হতে পারে।

‘নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া বার্মায় ফিরে যাওয়ার চেয়ে আত্মহত্যা করা আমার কাছে ভালো বলে মনে হচ্ছে,’ বলেন এ রোহিঙ্গা শরণার্থী।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *