চার ইস্যুতে আটকা বিএনপির নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত

নিউজ ডেস্ক:: একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে আরও আগেই। বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। ঘোষিত তফসিল অনুয়ায়ী ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে তোড়েজোড়ে। শুক্রবার থেকেই মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। বেশিরভাগ আসনে প্রার্থীও ঠিক করা আছে দলটির। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নির্বাচনী প্রস্তুতি থেমে নেই।

নির্বাচনী দৌঁড়ে পিছিয়ে নেই বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও। শিগগিরই মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু করবে দলটি।নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সিদ্ধান্ত ‍চূড়ান্ত করে রেখেছে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন এ দল।

সরকার ও বিরোধী দলে যখন নির্বাচনী ঢামাডোল চলছে ঠিক সেই মুহূর্তে রাজপথের বিরোধী দল এখনও ঠিক করতে পারেনি নির্বাচনে অংশ নেবে কি, নেবে না।

দলটির তৃণমূলসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। নির্বাচনের দেড় মাসেরও কম সময় আছে হাতে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট (জোটের সম্প্রসারণ হয়ে এখন ২৩ দল)এখনও নির্বাচনে যাবে কি যাবে না তা স্পষ্ট করেনি। আজ শনিবারও বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এ বিষয়ে জানতে হলে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। জানা গেছে, মূলত চারটি ইস্যুতে আটকে রয়েছে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত। ইস্যু চারটির প্রথমটি হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন।

তৃতীয়টি হচ্ছে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া।

চতুর্থত: নির্বাচনের সমতল ক্রীড়াভূমি (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) সৃষ্টি নিয়ে সংশয়। মূলত এই চারটি বিষয়ে সংশয় দূর হলে কিংবা সরকারের কাছ থেকে আশ্বাস পেলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে।

তবে এই চারটি ইস্যুর মধ্যে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তাঁর নির্বাচনে অংশগ্রহণের বাধা দূর করার বিষয়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিএনপি ও জোটের নেতাকর্মীদের কাছে।

বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী এই বয়সে খালেদা জিয়ার কারাবন্দি জীবন মেনে নিতে পারছেন না। তারা মনে করছেন খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচনে গেলে সরকারের পাতা ফাঁদে পা দেওয়া হবে।

বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারাও নির্বাচনে সমতল ক্রীড়াভূমির বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত আছেন। তাঁরা মনে করেন, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি না দিয়ে এবং মিথ্যা মামলায় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার বন্ধ না হলে নির্বাচন করে লাভ হবে না।

বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতারা আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়েও শঙ্কায় আছে। তারা শুরু থেকেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে আসছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুই দফা বৈঠকেও তারা এসব দাবি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। এসব বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা কিছুটা হতাশও। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে দলটির জৈষ্ঠ নেতারা দ্বিধাবিভক্ত। বড় একটি অংশ নির্বাচনে যেতে চাচ্ছেন। অপর একটি অংশ ঐক্যফ্রন্ট ঘোষিত ৭ দফা দাবি পূরণ না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে।

নির্বাচনের অংশ নেওয়ার পক্ষের বিএনপি নেতাদের যুক্তি হচ্ছে-এক দশক ধরে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বাইরে। এবারও অংশ না নিলে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা কঠিন হয়ে যেতে পারে। অনেকে স্বতন্ত্র কিংবা অন্য প্লাটফর্মে গিয়ে নির্বাচন করতে পারে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী বিএনপির নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যাবে। তখন দল আরও গভীর সংকটে পড়বে।

তাদের যুক্তি হচ্ছে, অবাধ নির্বাচনের নূনতম পরিবেশ সৃষ্টি হলে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত।এতে করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট কিংবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাই বেশী। আর যদি ক্ষমতায় নাও আসা যায় তাহলে বড় সংখ্যক আসনে জয়ী হয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব নিয়ে সংসদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যাবে। তখন স্বাভাবিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।। এতে করে দলীয় নেত্রীকে মুক্তির আন্দোলন আরও বেগবান করা সম্ভব হবে।

তবে বিএনপি জোটে যারা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে তাদের মত হচ্ছে- সাত দফা দাবির কোনো দাবিই আজও সরকার মানে নি। দুই দফা সংলাপ করেও দৃশ্যমান কোনো ফল আসেনি। এমতাবস্থায় বিএনপি জোট নির্বাচনে গিয়ে কি করবে?

নির্বাচনের সমতল ভূমি সৃষ্টি না হলে আর দলীয় নেত্রীকে জেলে রেখে নির্বাচনে অংশ নিলে ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। এমতাবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি জোট সরকারের পাতা ফাঁদে পা দেবে বলে মনে করছেন তারা।

বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না এমন প্রশ্নে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি অবশ্যই একাদশ নির্বাচনে অংশ নেবে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে যাবে বিএনপি।

এর বিপরীত মত দিয়েছেন বিএনপির স্থাযী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ৭ দফার কোনো দাবিই সরকার মানে নি। এমতাবস্থায় বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া মানে সরকারের পাতা ফাঁদে পা দেওয়া।

জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার রাতেই ২০ দলীয় জোটের বৈঠক হয়েছে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকও হয়েছে। উভয় বৈঠক থেকে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে বিভক্ত মত উঠে আসে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বৃহস্পতিবার বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বৈঠকে ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ হয়েছে। কী করা উচিত, কী করা উচিত না- এসব নিয়ে সবাই মতামত দিয়েছেন।

তিনি বলেন, বৈঠকে কেউ কেউ বলেছেন, সরকার তো তার জায়গা থেকে একটুকুও সরছে না। কিন্তু নির্বাচন করতে গেলে এখন আমরা অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন পাব না। নেতাকর্মী গ্রেফতার এখনও অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচনে গিয়ে সরকারকে বৈধতা দেয়া হবে। আবার কেউ বলেছেন, নির্বাচন না করলে দলের আরও ক্ষতি হতে পারে। তবে এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শুধু আলোচনা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে।

জোটের অন্যতম শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সাত দফা দাবি ছিল। এর কোনোটিই প্রধানমন্ত্রী মানেননি। সরকারের যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের সদিচ্ছা থাকত, তাহলে তারা দাবিগুলো মেনে নিত। কিন্তু এখন পর্যন্ত একদফা দাবিও মানা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, সংলাপের পর আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। তা-ও তিনি দেননি।

তিনি যদি তার বক্তব্যে ৭ দফা দাবির মৌলিক কিছু বিষয় মেনে নেন, তাহলে নির্বাচনে যাওয়ার পথ সুগম হতো।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *