নিউজ ডেস্ক:: প্রথমে সড়ক পরিবহন আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর সংসদে তা পাস হয়। এর আগে খসড়া আইনটির ওপর আইন মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক মতামত নেয়। অসংখ্য সভাও হয়। এর সবগুলো প্রক্রিয়াতেই নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের অংশগ্রহণ ছিল। কখনো তিনি মন্ত্রী, কখনো সাংসদ আবার কখনো পরিবহনশ্রমিকদের প্রতিনিধি। এরপরও সড়ক পরিবহন আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে শাজাহান খানের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।
গতকাল রোববার ভোর ছয়টা থেকে ৪৮ ঘণ্টার টানা পরিবহন ধর্মঘট পালন করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। ধর্মঘটের কারণে সারা দেশে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরি, প্রাইম মুভার টেইলার—সব ধরনের বাণিজ্যিক যান ও গণপরিবহনের চলাচল বন্ধ ছিল। সরকারের পক্ষ থেকেও ধর্মঘট অবসানে কোনো তৎপরতা ছিল না।
শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ নেতা শাজাহান খান। সড়ক পরিবহন খাতের মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান। মন্ত্রিসভার এই দুই সদস্য সড়ক পরিবহন আইন অনুমোদনের সময় কোনো বিরোধিতা করেননি। সংসদে পাস হওয়ার সময়ও আইনের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেননি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে গত ৬ আগস্ট সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে গত বছর নভেম্বরে মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন করে। মাঝখানে দীর্ঘদিন আইন মন্ত্রণালয় খসড়াটির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইনের শাস্তি ও জরিমানার কিছু বিধান নিয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো আপত্তি দিলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় শাজাহান খান ও মসিউর রহমান ছাড়াও মালিক সমিতির মহাসচিব এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ও শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে অপরাধ ও দণ্ডের বিধান নিয়ে পর্যালোচনা করতে সাত সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। কমিটিতে এনায়েত উল্যাহ ও ওসমান আলী অন্যতম সদস্য ছিলেন। সংসদে পাসের জন্য পাঠানোর আগে তাঁরা খসড়াটি নিয়ে একমত হয়ে সই করেন। ১৩ সেপ্টেম্বর খসড়াটি সংসদে পাঠানো হয়। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও আলোচনা হয়। এতে মালিক, শ্রমিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়া হয়। ১৯ অক্টোবর আইনটি সংসদে পাস হয়। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি করা হয় সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। অবশ্য নাগরিক সমাজ ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছিল।
এখন এই আইনের বিরোধিতা করে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট ডেকেছে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। তাদের দাবিগুলো হলো, সড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা জামিনযোগ্য করা, দুর্ঘটনায় চালকের ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা, ৩০২ ধারার মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা, পুলিশি হয়রানি বন্ধ, ওয়ে স্কেলে জরিমানা কমানো ও শাস্তি বাতিল এবং গাড়ি নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিনিধির প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করা।
এই বিষয়ে মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডেকেছেন, যানবাহন চালাবেন না। এখানে মালিকদের কিছু করার নেই। তিনি স্বীকার করেন, আইন প্রণয়নের আগে বিভিন্ন পর্যায়ে মালিক-শ্রমিকদের মতামত নেওয়া হয়েছে।
সরকার, মালিক ও শ্রমিক একাকার
শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘট ডাকলে মালিক সমিতিগুলো তা মেনে চলে। আর মালিক সমিতি কোনো কর্মসূচি দিলে শ্রমিকেরা তা বাস্তবায়ন করে। মালিক ও শ্রমিক সমিতি—দুটি পরস্পরের প্রতিপক্ষ হলেও পরিবহন খাতে তারা একে অপরের পরিপূরক। শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠনের নিয়ন্ত্রক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। তাঁর পরিবারের মালিকানায় ঢাকায় কনক পরিবহন নামে বেশ কয়েকটি রুটে বাস চলে। তাঁর পারিবারিক কোম্পানি সার্বিক পরিবহনের বাস চলে ঢাকা-মাদারীপুর পথে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন সূত্র জানায়, আজ সোমবার বর্তমান সংসদের অধিবেশন শেষ হচ্ছে। আইনটি এখন আর পরিবর্তনের সুযোগ নেই—এটাও মালিক-শ্রমিক সমিতিগুলো জানে। কিন্তু এখন ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের ‘শক্তি’ দেখানো। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে কোণঠাসা হয়ে সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে কোনো কথা বলেনি মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। এখন শক্তি না দেখালে সাধারণ শ্রমিক-মালিকদের কাছে নেতাদের এবং সমিতির ক্ষমতা খর্ব হয়ে যেতে পারে।
সরকারের একটি সূত্র জানায়, শক্তি দেখানোর ধর্মঘট ডাক দেওয়ার পর তা বন্ধে এবং আলোচনার মাধ্যমে জনদুর্ভোগ লাঘবের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিরোধীদের অবরোধ কর্মসূচিতে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা সরকারের কথায় ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় ছিলেন। ওই সূত্র জানায়, সাধারণত পরিবহনশ্রমিকেরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডাকেন। কিন্তু এবার তাঁদের কর্মসূচি দুই দিনের। ফলে সরকার এই দুই দিনের ধর্মঘট অনেকটা মেনেই নিয়েছে।
গতকাল সকালে এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, এখন আইন পরিবর্তনের সুযোগ নেই। পরবর্তী সংসদ অধিবেশন পর্যন্ত শ্রমিকদের অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে গতকাল সচিবালয়ে নিজের দপ্তর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকেরা ধর্মঘটের বিষয়ে প্রশ্ন করলে ‘কোনো মন্তব্য নেই’ বলে এড়িয়ে যান।
শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, আইন পাসের আগে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ হয়েছে, মতামত নেওয়া হয়েছে। তবে অর্ধেক মানা হয়েছে, অর্ধেক হয়নি। এ জন্যই ধর্মঘট। দাবি মানা না হলে বৈঠক করে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে বলে তিনি জানান।
টাকা আর ক্ষমতা—দুটিই আছে পরিবহন খাতে
সারা দেশে মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর নামে দৈনিক প্রতিটি বাস-মিনিবাস থেকে ৭০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এর মধ্যে মালিক সমিতি পায় ৪০ টাকা আর শ্রমিক সমিতির ৩০ টাকা। শ্রমিক সমিতির ৩০ টাকার মধ্যে স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়নের ২০ টাকা আর কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের ১০ টাকা।
মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর সূত্র জানায়, মালিক সমিতির সারা দেশে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে সারা দেশের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ওপর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে সারা দেশের বাণিজ্যিক যান ও গণপরিবহনের চাঁদা ফেডারেশন পায়।
নিয়মানুযায়ী, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর পরিচালনার জন্য মাসিক চাঁদা তোলার কথা। আর ফেডারেশনকে চাঁদা দেওয়ার কথা শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর, তা–ও বছরে একবার। কিন্তু ফেডারেশনও দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা পেয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৬ লাখ ৬৩ হাজার। এর মধ্যে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কারসহ ব্যক্তিগত যানের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। বাকি প্রায় সাড়ে আট লাখ যানবাহন বাণিজ্যিক বা গণপরিবহনে ব্যবহৃত হয়। মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর ৭০ টাকা হারে দৈনিক চাঁদা উঠে প্রায় ৬ কোটি টাকা। এর বাইরে অনিবন্ধিত হিউম্যান হলার, নছিমন, করিমন, ভটভটি থেকেও মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো চাঁদা তোলে। মালিক সমিতিগুলোর নামে জিপি, ওয়েবিল বা রুট খরচের নামে যে চাঁদা তোলা হয়, এর একটা অংশ খরচ হয় কোম্পানির অফিস ব্যবস্থাপনায়। এ ছাড়া পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানি বন্ধে, স্থানীয় রাজনৈতিক চাঁদাবাজদের পেছনেও কিছু টাকা ব্যয় হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়া যাবে না—এই দাবিতে আন্দোলন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে অপরাধের বিচার ন্যায়সংগত হয়েছে কি না, বা আইনের কোনো ধারা যুক্তিসংগত কি না, সেটা বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি আরও বলেন, সড়ক পরিবহন আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে। মন্ত্রিসভায় মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা আছেন। তখন কি তাঁরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন? তাঁদের বক্তব্য কি আমলে নেওয়া হয়নি? আর যদি বক্তব্য তুলে না ধরে থাকেন, এখন কেন এর বিরোধিতা করবেন? একই সঙ্গে দুই অবস্থানে থাকা স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এর নিরসন হওয়া উচিত।