স্মরণ- সিলেটের বিপ্লবী কণ্ঠ প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান (রহ.) মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী

১৯৯২ সালের কথা। ভারতের উগ্রহিন্দুরা যখন ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংস করেছিলো এবং পরবর্তী সময়ে নাস্তিক্যবাদী তসলিমা বিরুধী আন্দোলন থেকেই তার নাম শুনেছি। আমি তখন বিশ্বনাথের আমতৈল মাদরাসার ছাত্র। ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিশাল এড়িয়ায় রেজিস্ট্রারি মাঠে সাহাবা সৈনিক পরিষদের এক সম্মেলনে প্রথম শুনি সেই ‘বিপ্লবী মাওলানা’র বজ্রকন্ঠ। এরপরে সৈয়দপুরে। মাইলের পরে মাইল পায়ে হেটে লোকজন আসতো একজন বীর সিপাহীর ‘ওমরি হুংকার’ শুনার জন্য। জানেন কে সেই জন? বলছিলাম, ইসলামি আন্দোলনের কিংবদন্তি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের তৎকালীন নেতা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির, জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজিরবাজার মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান (রহ) এর কথা। নিজ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা এবং শিশু সন্তানের চিকিৎসা জনিত কারণে গ্রামের বাড়ীতে ছিলাম। ফলে একটি ঐতিহাসিক জানাযায় শরিক হতে পারিনি। বরেণ্য এই সাহসী বীরপুরুষের শেষ বিদায়ে অনুপস্থিত, সত্যিই এই কষ্টের কথা আমাকে আজীবন পীড়া দিবে।

অনেকবার তাঁর কাছে গিয়েছি। বিভিন্ন প্রশ্ন করেছি- উত্তর পেয়েছি। ২০১৫ সালে আমরা কয়েকজন মাসিক মদীনার অবদান’ শীর্ষক সেমিনার ও প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সম্মানে সিলেটে নাগরিক সংবর্ধনা’র আয়োজনের জন্য সম্মতি নিতে গিয়ে ছিলাম তাঁর কাছে। জামেয়া মাদানীয়া কাজিরবাজারের দফতরে তিনি আমাদের লিখিত ভাবে সম্মতি স্বাক্ষর দিয়ে উৎসাহিত করেছিলেন। সর্বশেষ গত ফেব্রæয়ারি ২০১৮ (সম্ভবত ১৩ তারিখ) জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজিরবাজার মাদ্রাসা দফতরে এক দোয়া মাহফিলে উপস্থিত হই। দোয়াটি ছিলো দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদকের মাতার মৃত্যুতে। প্রিন্সিপাল মাওালানা হাবীবুর রহমান সাহেবকে দিয়েই মোনাজাত করাতে চান-সাংবাদিক ফায়সাল আমীন ভাই। শুধুমাত্র তাঁর দোয়া নিতেই সেখানে মাহফিলের আয়োজন। সে দিন দোয়া মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন, নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রিয় নায়েবে আমীর মাওালানা রেজাউল করিম জালালী, সিলেট মহানগর সভাপতি মাওালানা সিরাজুল ইসলাম সিরাজী, মহানগর সেক্রেটারী মাওালানা এমরান আলম, জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজিরবাজার মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওালানা শাহ মম্শাদ, ভাইস প্রিন্সিপাল সাবির আহমদ মুসা, যুব জমিয়তের কেন্দ্রিয় প্রচার সম্পাদক রুহুল আমীন নগরী, মাদ্রাসা শিক্ষক আব্দুল খালিক, মাওলানা মামুন আহমদ, জমিয়ত নেতা মুজিবুর রহমান নানুমিয়া, হাফিজ কয়েছ আহমদ, মাওলানা নজির আহমদ, হাফিজ ইকরামুল হক জুনায়েদ, নুর আহমদ, দৈনিক ইনকিলাব এর ব্যুরো প্রধান ফয়সাল আমীন, ফটো সাংবাদিক মাহমুদ হোসেন, শেখ আব্দুল মজিদ প্রমুখ। অনুষ্ঠান শেষে আমি পাশে গিয়ে তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলাম। আমার প্রশ্ন শুনে ভালো করে থাকালেন-এমন সময় মাওলানা শাহ মমশাদ ভাই আরেকটু পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিলেন। একটি প্রশ্ন ছিলো-আপনি জীবন- সংগ্রামে সফল নাকি ব্যর্থ?

সেদিনকার উত্তরটি ছিলো এরকম : মুমিনের জীবন-সফলতা-ব্যর্থতার মাপকাঠি আলাহর হাতে। আমি আমার জীবনে যত আন্দোলন সংগ্রাম করেছি-একমাত্র আলহকে রাজি খুশি করার জন্যই। খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছি-মৃত্যুপর্যন্ত করে যেতে হবে। আমার কোন ব্যর্থতা নেই, এ জন্য কোনো আফসোসও নেই -কারণ সফলতা -ব্যর্থতার পরিমাপকারী আলাহপাক। আমাদের কাজ হলো আলাহর দ্বীন পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাওয়া। এটাই আমার আহবান সকলের প্রতি।’

বৃত্তান্ত: প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমানের সার্টিফিকেট ও পারিবারিক দিক থেকে জন্ম তারিখ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। তার জন্ম ১৯৪৫ মতান্তরে ১৯৫৩ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের হাজীপুর (ঘনশ্যাম) গ্রামে। তার পিতা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা মাওলানা মাহমুদ আলী ও মাতা আছিয়া খাতুন । বিশিষ্ট লেখক মাওলানা শায়খ তাজুল ইসলাম এর তথ্য মতে, ৮ জুলাই ১৯৫৩ সালে তার জন্ম।
লেখাপড়া: বুনিয়াদী শিক্ষা কওমিতেই। স্থানীয় বইটিকর প্রাইমারি স্কুল ও রুস্তমপুর কওমি মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। এপরে দেশের প্রাচীনতম গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি আজিজিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৭০ সালে ফাজিল পর্যন্ত পড়েন। পরে ১৯৭৩ সালে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল পাস করেন।

কর্মজীবন: ১৯৭৪ সালের জুন মাসে দেশের ক্বাঈদুল উলামা খলিফায়ে মাদানী আলামা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র)সহশীর্ষ আলেমদের তত্ত্বাবধানে সিলেটের কাজিরবাজার এলাকায় সুরমা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহ্যবাহী জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার মাদরাসা। দারুল উলুম দেওবন্দের নীতিতে পরিচালিত এই মাদরাসা শুরু থেকেই সিলেবাসে বাংলা, ইংরেজিসহ জাগতিক বিষয় যুক্ত করে নতুন ধারার সূচনা করেন। কওমি মাদরাসার প্রধানের পরিচয় মুহতামিম হলেও তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন প্রিন্সিপাল হিসেবে। প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ঢাকা বোর্ডের অধীনে চূড়ান্ত পরীক্ষার মধ্যে সর্বাধিক নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে কামিল (মুহাদ্দিস) ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কামিল পরীক্ষাকালীন সময় থেকে সিলেট শহরস্থ কাজির বাজার জামে মসজিদ কমিটির অনুরোধে ও ছদরে জমিয়ত মরহুম হযরত মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়ার নিদের্শে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৫ মার্চ ১৯৭৩ ইংরেজি তারিখে। এ সময় তাঁর বসয় ছিলো মাত্র ১৮ বছর।

জামেয়া মাদানীয়া প্রতিষ্ঠা মাওলানা শাহ মমশাদ সম্পাদিত ‘দ্বীপ্ত জীবন’ সংকলন থেকে জানাযায়, কাজির বাজার জামে মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালনকালে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সুব্যবহার, সুন্দর চরিত্র ও প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে তিনি এলাকার জনসাধারণের প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তিনি মসজিদ সংলগ্ন স্থানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কথা বললে সকলেই তা সানন্দে গ্রহণ করেন। সুরমা নদীল তীরবর্তী সিলেট শহরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র কাজিরবাজার। কাজির বাজার মসজিদের পার্শ্বে ডালিম গাছের নীচে ১৯৭৪ সালে মাত্র ৫/৭ জন ছাত্র নিয়ে তিনি একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। ছদরে জমিয়ত হযরত মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র)এর বিশেষ তত্তাবধানে সেই মক্তবটি দ্রুত উন্নতি লাভ করতে থাকে। ছাত্র সংখ্যাও বছরের পর বছর বাড়তে থাকে। স্বল্প পরিসরে স্থানে সংকুলান না হওয়ায় জামেয়ার জন্য এক খন্ড জমি খুঁজতে থাকেন। এ উদ্দেশ্যে জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল স্থানীয় গণ্যমান্য মুরুব্বিয়ানদের নিয়ে বাংলাদেশে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ৫ ডিসেম্বর ১৯৭৯ইং তারিখে সিলেট সার্কিট হাউজে সাক্ষাৎ করেন। কঠোর প্ররিশ্রমের পর শহরের মধ্যে এক খন্ড জমি মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ করা হয়। আল­াহর অসীম কুদরতে সেই নদীর তীরবর্তী মক্তবটি আজ অতি মূল্যবান ভূমিকার উপর স্থানান্তরিত হয়ে দেশের অন্যতম খ্যাতনামা ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরূপে সুপরিচিত। বর্তমানে জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলাম শিক্ষাগাররূপে স্বীকৃত। প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে বিশাল অবদান রেখেছেন। তিনি অসহায় মানবতার কল্যাণে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশেষ করে, আল মারকাজুল খাইরি, আল ইসলামী নামে সেবা সংস্থা প্রতিষ্ঠান করেছেন। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সিলেট জেলা সেক্রেটারি থাকাকালীন বার্মা থেকে বিতাড়িত মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাহায্যে কক্সবাজারে কয়েকদিন অবস্থান করেন। এসময় বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন।

রাজনীতি: প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান ঐতিহ্যবাহী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। তিনি কিছুদিন জেলা জমিয়তের সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন। ৮০’র দশকে যুগশ্রেষ্ঠ ওলী হযরত মুহাম্মদ হাফেজ্জী হুজুরের সূচিত তাওবার রাজনীতির একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে ১৯৮২ ইংরেজির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হুজুরের সফরসঙ্গী হয়ে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অ ল সফর করেন। পরবর্তীতে জমিয়তের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকও নিযুক্ত হন। রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রিন্সিপাল হাবীবের অভূত সাফল্য আসে আলামা হাফেজ্জী হুজুরের আদর্শ অনুসারে। উলে­খ্য, যুগের শ্রেষ্ঠ সাধকপুরুষ, ইসলামি আন্দোলনের নকীব হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) তাঁকে আন্তরিক স্নেহ করতেন এবং খাসভাবে তাঁর জন্য দোয়া করেছেন। ১৯৭৭-৮১ সাল পর্যন্ত ৫বছর তিনি ছিলেন সিলেট জেলা জমিয়তের সেক্রেটারি জেনারেল। তখনকার সভাপতি ছিলেন আলামা রিয়াসত আলী চৌঘরি ও আলামা শফিকুল হক আকুনি রাহ.। ১৯৯৪ সালে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়ে সারাদেশে আলোচিত হন প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান। তার সংগঠন সাহাবা সৈনিক পরিষদের ব্যানারে সিলেটে অসংখ্য সভা-সমাবেশ করেন। তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন তসলিমা নাসরিন। এছাড়াও দেশের নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলনের কারণেও তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি পান। ২০১২ সালে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির শায়খুল হাদিস আলামা আজিজুল হক রাহ. মৃত্যুবরণ বরণ করলে তিনি দলের আমির নিযুক্ত হন। মৃত্যুপর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ছিলেন। খলিফায়ে মাদানী ক্বাঈদুল উলামা আল্লামা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া ও ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ লংমার্চ নেতা, শায়খুল হাদীস আলামা আজীজুল হকের একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী এবং ইসলামি ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় নেতা।

তাছাড়াও তিনি সময়ের প্রয়োজনে দেশ,জাতি ধর্মের বৃহত্তর স্বার্থে যখনই প্রয়োজন মনে করেছেন ছোটখাটো মতবিরোধ ভুলে সমমনা, সমআদর্শের যে কারোর সাথেই ঐক্য করেছেন নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন, তৎপরতা চালিয়েছেন। এক্ষেত্রে উলে­খ করা যেতে পারে ফুলতলীর পীরসাহেব হযরত মাওলানা আব্দুল লতীফ চৌধুরীকে সভাপতি ও প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে ইসলামী ঐক্যজোটের পরিষদ গঠনের কথা। এ পরিষদের পৃষ্টপোষক ছিলেন হযরত মাওলানা আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়ার মতো প্রবীণ উলামায়ে কেরাম। উক্ত কমিটিতে কওমী, সরকারি, বেসরকারি মাদ্রাসার উলামায়ে কেরামগণ সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইসলামি ঐক্য পরিষদের আহবানে ১৩ আগস্ট ১৯৯৩ ইং এক ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

উক্ত মহাসমাবেশে বৃহত্তর সিলেটের সকল অ ল ছাড়াও দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরাম, পীর মাশায়েখগণ অংশগ্রহণ করেন। এপরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত নামকরণ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত সংগ্রাম পরিষদে সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান যা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও একটি প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছিলো। উক্ত সংগ্রাম পরিষদে প্রথমবারের মতো এককালের চরম বৈরি মনোভাবাপন্ন সব রাজনৈতিক নেতাদের একই মে দেখা যায়। ঐ সময় স্থানীয় কোর্ট পয়েন্টে যে ঐতিহাসিক সমাবেশ হয়েছিলো, এতে সভাপত্বি করেছিলেন প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান, নূর উদ্দিন আহমদ গহরপুরী, আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলীসহ জামায়াতে ইসলাম, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামি ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, আঞ্জুমানে আল ইসলাহর উলে­খযোগ্য নেতাকর্মী।

২০০৯ সালে সিলেটে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকে জালালাবাদ লেখক ফোরামের পক্ষ থেকে সংর্বধনা প্রদান করা হয়। এসময তিনি দুই দিন সিলেট অবস্থানকালে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। ২০ মার্চ শুক্রবার জুম্মার নামাজের উদ্দেশ্যে আমরা খান সাহেবেকে নিয়ে জামেয়া মাদানিয়া কাজিরবাজার মাদরাসা মসজিদে হাজির হই।

এসময় প্রিন্সিপাল সাহেব বয়ানরত ছিলেন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের উপস্থিতি দেখে তিনি নিজেই ঘোষণা দিলেন। এই জামেয়ার ভ‚মি জটিলতায় মাওলানা খানের অবদানের কথা কৃতজ্ঞাচিত্তে স্মরণ করেন। খুৎবাপূর্ববতী সংক্ষিপ্ত বয়ান দিলেন খান সাহেব। এর পরে জামেয়া দফতরে কিছুসময় অতিবাহিত করেন। সেদিন জামেয়া মাদানিয়ার ভ‚মি জটিলতায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের বিশেষ অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে
অশ্রæসিক্ত হন মরহুম প্রিন্সিপাল (র)। সিলেটের সাহসীকণ্ঠ প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান প্রসঙ্গে বিগত ২৭/১০/২০০৮ তারিখে আমার সাথে (এই লেখকের) আলাপচারিতায় মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দনি খান বলেছিরেন, সিলেটের কিছু লোকের ঠেলাঠেলির কারণে জমিয়ত থেকে অনেকেই দুরে চলেগেছে। মাওলানা (প্রিন্সিপাল) হাবীবুর রহমান তাদের একজন। আমি যখন জমিয়তে তোলাবায়ে আরাবিয়ার সভাপতি ছিলাম , তখন হাবীবুর রহমান আমার কর্মী ছিলো। তার আমলে জমিয়তের অবস্থান সিলেটে ভালই ছিলো। আর এখন শুধু মাইনাস র্ফমুলা! মাওলানা আব্দুল গাফ্ফার মামুরখানী, মাওলানা আব্দুলাহ হরিপুরীকে জমিয়তের দাওয়াত দিতে সিলেট গিয়েছি। এমনকি গাছবাড়ী ও ঝিঙ্গাবাড়ী আলিয়া মাদরাসায় জমিয়তের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছি। আপনারা সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করবেন। সামনে আপনাদের অনেক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।’

জেল জুলুম
ইসলাম ও সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারি নির্যাতন, কারাভোগ করতে হয়েছে প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানকে। ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জুয়া, হাউজি, অশ্লীল নাচ-গান ইত্যাদি সমাজবিরোধী মেলা আয়োজনের প্রতিবাদে হাজার হাজার মুসল্লি নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ বিক্ষোভ মিছিল থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। পবিত্র রমজান মাসে সিলেট শহরের কাজির বাজারে প্রভাশালী ছত্রছায়ায় দিনের বেলা হোটেল খোলা রেখে প্রকাশ্যে পানাহার চালানোর প্রতিবাদে প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। এতে প্রভাশালী মহল ক্ষিপ্ত হয়ে মিছিলের ওপর বর্বর হামলা চালায় এবং এক পর্যায়ে প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানকে নাটকীয়ভাবে গ্রেফতার করে। অথচ পরদিন ভোরের ফ্লাইটে তাঁর হজে যাওয়ার কথা ছিলো। তৌহিদী জনতার স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনে পরে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। ধর্মদ্রোহী তসলিমা নাসরিনের ফাঁসির দাবিতে ১৯৯৪ সালের ৩০ জুন দেশব্যাপি হরতাল পালনকালে সিলেটে তিনি কঠোর কর্মসূচি প্রদান করেন। ২০০০ সালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হলের বিতর্কিত নামকরণের প্রতিবাদে তিনি বিশেষ ভ‚মিকা পালন করেন। সর্বশেষ ১/১১এর মঈনুদ্দিন- ফখরুদ্দিনের আমলে বিশেষ ক্ষমতা আইনে প্রায় ৯ মাস কারাভ্যন্তরিন ছিলেন। সেই অভিশপ্ত শাসনামল থেকেই তিনি শারিরীক ভাবে দুর্বল হয়ে যান।

ইন্তেকাল,প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান দীর্ঘদিন থেকে ডায়াবেটিস ও হাই প্রেশারসহ শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। গত ৭ অক্টোবর তিনি চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দু’দিন আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন। গত ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর। শুক্রবার মধ্যরাতে আমাদেরকে রেখে তিনি শেষ নি:শাস ত্যাগকরেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক স্ত্রী, চার ছেলে ও তিন কন্যা সন্তানের জনক। তার বড় ছেলে মাওলানা মুসা বিন হাবীব জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল। দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা ইংল্যান্ড প্রবাসী। তৃতীয় ছেলে তারেক বিন হাবীব সিলেট মহানগর ছাত্র মজলিসের সভাপতি, চতুর্থ ছেলে তায়েফ বিন হাবীব ইংল্যান্ড প্রবাসী। তাঁর বড় জামাতা মাওলানা তাজুল ইসলাম, দ্বিতীয় জামাতা মাওলানা আতাউর রহমান ইংল্যান্ড প্রবাসী, ছোট জামাতা মাওলানা সহল আল রাজি ব্যবসায়ী ও সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য।

“লেখক: সভাপতি, মাদানী কাফেলা বাংলাদেশ”। ০১৭১৬৪৬৮৮০০।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *