রোহিঙ্গা সঙ্কটের ১ বছরপূর্ণ: ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত

নিউজ ডেস্ক::
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর এক বছর পূর্ণ হলো আজ। গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিধনে অভিযান শুরু করে। পূর্ব পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত এই অভিযানে নিহত হয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। তাদের ওপর হত্যা, ধর্ষণসহ সব ধরনের অত্যাচার চালানো হয়।

আরসা নামক একটি সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যদের সেনা ছাউনিতে হামলার ঘটনার অজুহাতে গত বছর ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার বাহিনী। দেশটির সেনা, বিজিপি ও উগ্রবাদী রাখাইন যুবকরা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা নর-নারী, শিশুর ওপর বর্বরোচিত নৃশংসতা চালায়। প্রাণ বাঁচাতে বানের পানির মতো বাংলাদেশের দিকে ছুটতে থাকে রোহিঙ্গারা। বর্তমানে নতুন-পুরনো মিলে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে (রোহিঙ্গা নিবন্ধনে নিয়োজিত) বাংলাদেশ পাসপোর্ট অ্যান্ড ইমিগ্রেশন অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে।

দেশটির রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংসতায় নিহত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ২৫ হাজারের কাছাকাছি। ১৯ হাজার রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৪৩ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু গুলিতে আহত হয়েছে, অগ্নিদ্বগ্ধ হয়েছে ৩৬ হাজার আর মারধরের শিকার হয়েছে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার মানুষ। ‘ফোর্সড মাইগ্রেশন অব রোহিঙ্গা:দ্য আনটোল্ড এক্সপেরিয়েন্স’ শীর্ষক গবেষণাটি করেছে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কানাডা, নরওয়ে এবং ফিলিপাইনের শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি রিসার্চ কনসোর্টিয়াম।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতাকে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র নিধনযজ্ঞ বলে অভিহিত করেছে। বিপুল সংখ্যা রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়ার এই সংকটকে দ্রুত বর্ধমান শরণার্থী সংকট বলে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআর। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছে। নিন্দা জানানো ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি মিয়ানমারের পক্ষে থাকা চীন ও রাশিয়ার জন্য। তবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও ইউনিটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সামরিক সহযোগিতা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্য।

এখনো রাখাইনে অবরুদ্ধ হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে লাখো রোহিঙ্গা। তার পরও সেখানে জাতিগত বিদ্বেষ কমেনি। আর এই সংকট নিয়ে মিথ্যাচারের জন্য বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়েন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরবতার জন্য তার নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।

এক বছরেও মিয়ানমারের পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা স্বদেশ ফেরা নিয়ে রয়েছেন অনিশ্চিয়তায়। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে উত্তর রাখাইনে এখন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের মংডু, বুথিডাউং শহরে সান্ধ্যাকালীন কারফিউর মেয়াদ আরো দুই মাস বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে রোহিঙ্গা এ সমস্যা সমাধানে গত এক বছরে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবি করেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকাররি সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। শুক্রবার (২৪ আগস্ট) অ্যামনেস্টির এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বর্ষপূর্তিকে লজ্জাজনক বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

সংস্থাটি মনে করছে- বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতার কারণেই রোহিঙ্গা নিধন ও জাতিগত নিপীড়ন চালিয়েও রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা এখনো বহাল তবিয়তে আছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলেও এভাবে অনিশ্চিত ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে চান না তারা।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *