মুনাফার লোভে বিশৃঙ্খলা বিশৃঙ্খলায় দুর্ঘটনা…

নিউজ ডেস্ক:: রাজধানীর গণপরিহনের প্রতিটি ধাপই অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত। একাধিক কোম্পানির বাস চলছে প্রতিটি রুটেই। আবার একই কোম্পানির রয়েছে অনেক মালিক। পরিবহন মালিক ও চালকদের মুনাফার প্রতিযোগিতায় ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। বাসে বাসে প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি বন্ধের উদ্যোগ এক দশক ধরে পরিকল্পনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। উদ্যোগ বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাড়ছে লাশের সারি।

সরকারি হিসাবে গত বছর ঢাকার ব্যস্ত পথে প্রাণ গেছে ৪১৭ জনের। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার ৩৬ ভাগ ঘটে শহরাঞ্চলে। শহরাঞ্চলের দুর্ঘটনার ৭৪ ভাগ ঘটে ঢাকায়।

এআরআই-এর সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ সমকালকে জানান, সারাদেশে দুর্ঘটনায় বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকায় ক্ষতি হয় সাত হাজার কোটি টাকা। এর প্রধান কারণ গণপরিবহনে নৈরাজ্য।

গত রোববার রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম। বাসের অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা সেখানে ফুটপাতে দাঁড়িয়েছিলেন। জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস ওই ফুটপাতের সামনে এসে দাঁড়ায়। পেছন থেকে একই পরিবহনের আরেকটি বাস বাম পাশ দিয়ে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এ সময় বাসের চাপায় নিহত হন দুই শিক্ষার্থী। আহত হন আরও অনেকে।

এ দুর্ঘটনার কারণ বিশ্নেষণ করে সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘বাস দুটি যাত্রী পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কারণ একই কোম্পানির হলেও বাস দুটির মালিক ছিলেন ভিন্ন দুই জন। ঢাকায় দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ, যাত্রী পেতে ফুটপাত ঘেঁষে বাঁ পাশের লেনে বাস দাঁড় করানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার কারণেই কয়েক মাস আগে কলেজছাত্র রাজীবের মৃত্যু হয়। কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে।’ এর আগে গত এপ্রিল মাসেও ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতে দাঁড়ানো এক তরুণী পা হারান বাসের চাপায়। যার কারণ, এআরই-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে. ‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা।’

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাসগুলোর বাইরের গায়ের দিকে তাকালেই গণপরিবহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। নগরের অভ্যন্তরীণ পথে চলাচলকারী প্রতিটি বাসের গায়ে পড়েছে হাজারো আঁচড়।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল সমকালকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চালক যতটা দায়ী, ততটা দায়ী পরিবহন ব্যবস্থাপনাও। ২০১৬ সালের আগস্টে রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে ‘ঢাকা চাকা’ বাস চালু করা হয়। গত দেড় বছরে গুলশান ও বনানীতে একটি দুর্ঘটনাও ঘটেনি। ‘ঢাকা চাকা’ বাসের গায়ে একটি আঁচড়ও নেই। কারণ, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা। কিন্তু ঢাকার অন্য এলাকায় প্রতিদিন মানুষ মরছে। ‘ঢাকা চাকা’ প্রমাণ করেছে অনিয়ম দূর হলে সড়ক নিরাপদ হবে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, ঢাকার সড়ককে নিরাপদ করতে হলে একটি সড়কে একটি কোম্পানির বাস থাকতে হবে। মুনাফা সমবণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। উন্নত দেশে বাস ফ্র্যাঞ্জাইজি নামে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ঢাকাতেও একসময় তা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

বিশৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় কারণ, চুক্তিতে বাস চালানো। চালক-হেলপারকে বেতন না দিয়ে মালিকরা দিন চুক্তিতে বাস দিয়ে থাকেন। চালকরা চুক্তির টাকা তুলতে মরিয়া হয়ে বাস চালায় ও যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় নামে। দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা টানা পরিশ্রমের ‘ক্লান্তি’ কাটাতে অধিকাংশ চালক-হেলপারই ইয়াবা সেবন করে। মালিক সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ নিজেই এ তথ্য সমকালকে জানিয়েছেন।

বেসরকারি সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৭ সালের তুলনায় চলতি বছরে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২২ শতাংশ। রাজধানীতে চলাচল করা আট হাজার মিনিবাস-বাসের ৮৭ শতাংশই অনিয়মে জড়িত। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, দৈনিক চুক্তিতে বাস চলার কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা সমকালকে জানিয়েছেন, বাস পথে নামানোর প্রথম ধাপ থেকেই শুরু হয় অনিয়ম। রাজধানীতে আড়াই শতাধিক রুটে ২৪৬টি কোম্পানির প্রায় পৌনে আট হাজার বাস-মিনিবাস চলে। মালিক রয়েছেন তিন হাজারের মতো। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় বাসে বাসে চলে প্রতিযোগিতা। কারণ চাঁদাবাজি। প্রতিদিন সকালে একটি বাস পথে নামাতে গেটপাস (জিপি) বাবদ দিতে হয় ১০০ টাকা। যে কোম্পানির অধীনে বাস চলে, তার নাম ব্যবহারে দৈনিক ‘চাঁদা’ দিতে হয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। মালিক ও শ্রমিক সমিতিতে চাঁদা দিতে হয় ৭০ টাকা। টার্মিনালভিত্তিক সমিতিতেও চাঁদা দিতে হয় কোনো কোনো বাসকে। এ ছাড়াও ‘পথ খরচ’ বা ‘ঘুষ’ দিতে হয় ট্রাফিককে। এভাবে একটি বাসকে দিনে কমপক্ষে এক হাজার ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

দিন চুক্তিতে চলা বাসগুলোর চালককে চাঁদার বাইরেও দৈনিক দুই থেকে তিন হাজার টাকা ‘জমা’ দিতে হয় মালিককে। তেল, গ্যাস ও হেলপারের খরচও চালকের। এসব খরচের চাপ সামলাতে চালক বেপরোয়াভাবে বাস চালান। তুরাগ পরিবহনের চালক আবদুল খালেক এসব তথ্য সমকালকে জানান।

বাসে বাসে প্রতিযোগিতা বন্ধে একটি রুটে একটি কোম্পানির বাস চলবে- ‘বাস নেট’ নামে এমন একটি পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয় কয়েক বছর আগে। এ পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞরা সমাধানের আশা করলেও এবং প্রকল্পটির প্রাক-উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপিপি) হলেও তা বাস্তবায়নে গতি নেই।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *