দুই বছরও টিকছে না নতুন সড়ক!

নিউজ ডেস্ক::  উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। কিন্তু কোথাও কোথাও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে দেশের সড়ক বা মহাসড়কগুলো নির্মাণের পরও তা বেশিদিন টিকছে না। বছর না ঘুরতেই নতুন নির্মিত সড়ক ভেঙেচুরে একাকার হয়ে পড়ছে। খানাখন্দ আর কার্পেটিং উঠে চলাচলের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। অথচ অধিকাংশ সড়ক ২০ বছর টেকসই হবে- সেভাবে ডিজাইন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত ভার বহন এবং মানহীন নির্মাণ কাজের কারণে দুই দশকের সড়ক দুই বছরও টিকছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এই প্রধান দুই কারণ ছাড়াও অতিবৃষ্টি, বৃষ্টির পানি জমে যাওয়ায় সড়কের ক্ষতি হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।

দেশের অধিকাংশ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের নির্মাণ পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও নির্মাণ কাজে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো কোনো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই সড়কের কিছু অংশ যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এতে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছে মানুষ।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প শেষ হয়েছে গত বছরের জুনে। প্রকল্প বাস্তবায়নের এক বছর পার না হতেই এ মহাসড়কের অনেক জায়গায় কার্পেটিং উঠে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। যে কারণে এই মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যায় প্রায় হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর রক্ষণাবেক্ষণের নতুন প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

একই অবস্থা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেরও। জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেন তৈরি ও বর্তমান সড়কটি উন্নত করার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। একপাশে সড়ক নির্মাণ ও মেরামতের কাজ হচ্ছে, অন্যপাশে ভাঙছে। কালিয়াকৈরের চন্দ্রায় কিছুদিন আগে কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন সেখানে অনেক জায়গায় কার্পেটিং উঠে গেছে। কোথাও কোথাও গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।

রাজশাহী-রংপুর, সিলেট-জাফলং, গোলাপগঞ্জ-জকিগঞ্জ, যশোর-নড়াইল সড়ক মেরামতেও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে চলতি বছরের এডিপিতে। দেশের অন্যান্য এলাকার নতুন সড়কও নির্দিষ্ট সময়ের আগে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে এডিপিতে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে।

দেশের রাস্তাগুলো যে টেকসই হচ্ছে না তা খোদ সরকারের জরিপেও উঠে আসছে। রাস্তার মান নিয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (এইচডিএম) সার্কেল ‘রোড রাফনেস সার্ভে’ করে থাকে। সর্বশেষ জরিপ করা হয়েছে ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি সময়ে। জরিপে দেশের সড়কগুলোকে ভালো, মোটামুটি, নিম্নমান, খারাপ ও খুব খারাপ- এই পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, দেশের ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক খারাপ ও খুব খারাপ মানের। ২০১৬ সালের আগস্টে প্রকাশিত এইচডিএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক খারাপ মানের। আঞ্চলিক ও জেলা সড়কের মান আরও খারাপ। ২০১৬ সালের জরিপে দেখা যায়, জেলা শহরগুলোর প্রায় ৪৭ শতাংশের বেশি সড়ক কোনো না কোনোভাবে ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে।

দেশের প্রধান সড়কগুলোর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের। এ জন্য সরকার কোন ধরনের যানবাহন কী পরিমাণ ওজনের মালপত্র বহন করবে তার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এ নীতিমালার আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন স্থানে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এ নীতিমালা অমান্য করলে আর্থিক জরিমানাসহ শাস্তির বিধান রয়েছে। কোন ধরনের গাড়িতে সর্বোচ্চ কত পরিমাণ ওজন বহন করা যাবে সে বিষয়ে ‘মোটরযানের এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা’ রয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী সামনে দুই চাকা আর পেছনে চার চাকা আছে এমন গাড়ি সর্বোচ্চ সাড়ে ১৫ টন ভার বহন করতে পারবে। আট চাকার গাড়ি পারবে সোয়া ১৬ টন ও ১০ চাকার গাড়ি পারবে সোয়া ১৮ টন ভার বহন করতে। অন্যান্য গাড়ির ক্ষেত্রেও ওজনের সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ গাড়িই তা মানছে না।

ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগারহাট এলাকায় এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন রয়েছে। ওই স্টেশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভারী মালপত্র পরিবহনকারী যানগুলো নীতিমালা ভঙ্গ করে অতিরিক্ত ভার বহন করে। প্রথম দিকে যানগুলোকে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে তা আর হবে না। নীতিমালার অতিরিক্ত ভার নিয়ে আসা যানবাহনকে যে পথে এসেছে সেই পথে ফেরত পাঠানো হবে। অথবা অতিরিক্ত মালপত্র আনলোড করে গন্তব্যে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে। আর অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে এই বিজ্ঞপ্তি কেউ মানছেন না। নীতিমালা বাস্তবায়নেও গড়িমসি লক্ষ্য করা যায় নানা কারণে। বর্তমানে ৬ চাকার (সামনে ২ ও পেছনে ৪ চাকা) গাড়ি কমপক্ষে ২২ টন মাল বহন করছে। অন্যান্য গাড়ি আরও বেশি বহন করে থাকে।

চট্টগ্রাম, বেনাপোল, হিলি, ভোমরা, তামাবিল বন্দর থেকে আমদানি করা পণ্য নিয়ে প্রচুর ট্রাক ঢাকা ও তার আশপাশের জেলাগুলোতে আসে। বন্দর থেকে যেসব ট্রাক ইস্পাত, শিল্পের কাঁচামাল নিয়ে আসে সেগুলোর অধিকাংশই অতিরিক্ত বোঝাই থাকে। এসব ট্রাকের মধ্যে ৬ চাকার সিংহভাগ ট্রাকই অনুমোদিত সীমার বেশি মাল বহন করে। আবার সিলেট অঞ্চল থেকে পাথর ও চীনামাটি নিয়ে যেসব ট্রাক ঢাকা আসে সেগুলোর সবই কমপক্ষে ২৫ টন বা তার বেশি ওজন নিয়ে আসছে। সম্প্রতি সরকারের বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণে পাথরের ব্যবহার বেড়েছে। এতে পাথর নিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে। এ ছাড়া ইটভাটার কয়লা বহন করছে যেসব পরিবহন সেগুলোও অতিরিক্ত মালপত্র নিচ্ছে। উত্তরাঞ্চল থেকে চাল নিয়ে যেসব গাড়ি ঢাকায় আসছে সেগুলো কমপক্ষে ২৫ টন লোড নিয়ে আসে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের ময়মনসিংহ জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ওভারলোড সড়ক নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ। একেকটি গাড়ির যে পরিমাণ ভার বহনের কথা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভার বহন করে থাকে। এতে সড়ক ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সড়কের ‘লাইফ টাইম’ কমে যায়। আবার সড়কগুলোতে যেসব জায়গায় বাজার রয়েছে সেখানে উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকাও সড়ক নষ্ট হওয়ার কারণ। তবে সম্প্রতি বাজার আছে এমন জায়গায় কংক্রিটের সড়ক করা হচ্ছে। তবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

সিলেট অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা সমকালকে বলেন, বিভিন্ন কারণেই সড়ক নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত ভার বহন। এ ছাড়া অতিবৃষ্টি, সড়কে পানি জমেও যাওয়াও অন্যতম কারণ।

আরেকজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডিজাইন অনুযায়ী নির্মাণ না হওয়া, ঠিকমতো মাটি পরীক্ষা না করা, তাড়াহুড়া করে নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে সড়ক টিকছে না। অপরদিকে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাদের তারাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে কোনো সড়কই টিকবে না। তিনি বলেন, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার হচ্ছে। সড়ক নির্মাণের যে ‘কিউরিং পিরিয়ড’ থাকে, তাও মানা হচ্ছে না।

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের মানোন্নয়নে অনেক প্রকল্প নিয়েছে সরকার। ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ জোনের গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়কের মানোন্নয়নে প্রকল্প রয়েছে এডিপিতে। এ ছাড়া যশোর-খুলনা মহাসড়কের পালবাড়ী থেকে রাজঘাট অংশের মানোন্নয়ন, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের মানোন্নয়ন, বাগেরহাট-চিতলমারী-পাটগাতী সড়কের মানোন্নয়ন, নেত্রকোনা-বিশিউড়া-ঈশ্বরগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন, রাজাপুর-পাথরঘাটা সড়কের ঝালকাঠি অংশের উন্নয়নসহ অনেক সড়কের মানোন্নয়নে প্রকল্প রয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রকল্প রয়েছে বিভিন্ন সড়ক মজবুত করার জন্য।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন শ্রেণির সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার। আর ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক। বাকি ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার জেলা সড়ক। সওজ সূত্র জানায়, জাতীয় মহাসড়কের পেভমেন্টের আয়ুস্কাল ধরা হয় ২০ বছর। যান চলাচলে বার্ষিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ‘রোড পেভমেন্ট ডিজাইন গাইডলাইন-২০০৫’ অনুযায়ী এ আয়ুস্কাল নির্ধারণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *