ভালোবাসার কাছে পঙ্গুত্ব হার মানলো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: এ কাহিনী পড়ে যাওয়া থেকে উঠে দাঁড়ানোর। এ কাহিনী দুরন্ত প্রেমের এবং দুনিয়াকে বুঝিয়ে দেয়ার যে, একটু ভরসা পেলে আর কাছের মানুষেরা পাশে থাকলে অচল হয়েও আবার জীবনে ফিরে আসা যায়!

পৃথিবীটাই থমকে গিয়েছিল বীরভূমের পাড়ুইয়ের নার্গিসের। জীবনের মূল স্রোত থেকে অচল হতে বসেছিলেন। কিন্তু আব্দুল তা হতে দেননি। নার্গিসের যাবতীয় শারীরিক সমস্যার কথা জেনেও তাকে ভালবাসলেন, নির্ভরতা দিলেন, ধৈর্য ধরে আগলে রাখলেন তিনি। বিয়ে করলেন দু’জনে। আব্দুলের সাহস ছড়িয়ে গেল নার্গিসের মধ্যেও। তিনিও পারলেন ঘুরে দাঁড়াতে। আচমকা আসা পঙ্গুত্ব মানেই যে এক নিমেষে সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়, তার নজির তৈরি করেছেন নার্গিস আর আব্দুল।

বছর ছয়েক আগে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় শিরদাঁড়ায় মারাত্মক আঘাত পান নার্গিস। ১৮ দিন কোমায় ছিলেন সদ্য বিবাহিত ১৭ বছরের ওই তরুণী। সেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তার প্রথম স্বামীর। নার্গিসকে ‘রেফার’ করা হয় কলকাতায়। এখানে ‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি’ এবং এসএসকেএম হাসপাতালে সব মিলিয়ে টানা প্রায় তিন বছরের চিকিৎসা। এখনও একা দাঁড়াতে পারেন না। বসে বসেই চলাফেরা করতে হয়। ঘরের টুকিটাকি কাজও করেন বসে। বসতে হয় পিছনে বালিশ দিয়ে। মলমূত্র ত্যাগেও সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তাকেই সহধর্মিণী করতে এক মুহূর্ত সময় নেননি আব্দুল কুদ্দুস। গত ৩ জুলাই সুস্থ-সবল শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছেন নার্গিস ওরফে সোমা। জমিয়ে সংসার করছেন তারা।

বীরভূমের কেন্দ্রডাঙাল গ্রামের আব্দুল শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। ফলে সামাজিক বাধা আসা স্বাভাবিক ছিল। জেনেশুনে প্রতিবন্ধী মেয়েকে কি কেউ সুস্থ ছেলের ঘরণী বলে মানতে পারে? কিন্তু কোনো বাধাই আব্দুলকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি।

বিয়ের পরে কোনো আফশোস, অনুশোচনা? কোনো হীনম্মন্যতা বোধ নার্গিসের তরফে? দু’জনেই উত্তর দিয়েছেন—‘না।’

আব্দুলের কথায়, ‘একটা মেয়ে টানা কয়েক বছর সুস্থ হতে লড়ছে। ঝড় বয়ে গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। তা-ও যখনই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখনই ওকে ঝলমলে দেখেছি। পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার কঠিন লড়াইটা চালাচ্ছে নিঃশব্দে, হাসিমুখে।

’ আব্দুল আরও বলেন, ‘শুধু একটা মানুষের দৈহিক সৌন্দর্য দেখে ভালবাসা হয় না। নার্গিসের মনের জোর, জীবনে ফেরার তাগিদ আর লড়াইয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই লড়াইয়ে আমি ওর পাশে থাকতে চাই আজীবন।’ আর লাজুক হেসে নার্গিসের মন্তব্য, ‘আমার স্বামী বা বাড়ির লোক কখনও এমন আচরণ করেননি, যাতে মনে হয় যে, আমি তাদের বোঝা, বা আমাকে নিয়ে ওরা লজ্জিত।’

স্বামীর কথা উঠতেই বললেন, ‘আব্দুল সব জায়গায় আমাকে কোলে করে নিয়ে যায়। কোলে করে চেয়ারে বসায়, গাড়িতে তোলে। ওর কোলে চড়েই একসঙ্গে কেনাকাটা করি, সিনেমা দেখি, আত্মীয়দের বাড়ি যাই। এমনকি, বাড়ির দোতলাতেও ও আমাকে কোলে করে তোলে।’

দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষের পুনর্বাসনে বাড়ির লোকের বা কাছের মানুষের এই ভরসা বা পাশে থাকার গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা স্বীকার করেছেন নার্গিসের চিকিৎসক, এসএসকেএমের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রাজেশ প্রামাণিক। তার কথায়, ‘এই মানুষরাও যে জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে পারেন, কাজকর্ম করতে পারেন, যৌন জীবন-যাপন করতে পারেন, সন্তানের জন্ম দিতে পারেন— এটা প্রত্যেকের জানা উচিত। চিকিৎসার পাশাপাশি দরকার কাছের মানুষদের একটু পাশে থাকা, ধৈর্য রাখা, সাহস জোগানো, ক্যাথিটার লাগানো বা হাঁটার চেষ্টার সময়ে একটু সাহায্য করা। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় ওষুধের থেকে কোনো অংশে এর প্রভাব কম নয়।’

নার্গিস-আব্দুলের কাহিনীর সাথে যেন মিল রয়েছে মণিরত্নমের ‘গুরু’ ছবির। গুরুতর অসুখে পঙ্গু মিনুকে (বিদ্যা বালান) ভালবেসে আপন করেছিলেন শ্যাম সাক্সেনা (মাধবন)। সেই ছবিতে শ্যামও মিনুকে কোলে নিয়ে চলাফেরা করতেন। নার্গিস আর আব্দুল ‘গুরু’ দেখেননি। তবে নিজেদের জীবনের গল্পেই তাঁরা এনেছেন সেলুলয়েডের গল্পের চমক!

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *