অর্থনীতি ডেস্ক:: সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সবধরনের সঞ্চয়পত্রসহ জাতীয় সঞ্চয়স্কিমগুলোতে নিট ঋণ এসেছে ৪৭ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল মে মাসে এসেছে সাত হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা, যা দেশের সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এর আগে একক মাস হিসেবে সঞ্চয়পত্রের নিট ঋণের রেকর্ড ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে এ খাতের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৪২০ কোটি টাকা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে জাতীয় সঞ্চয়স্কিমগুলোতে মোট বিনিয়োগ এসেছে ৭৭ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।
ব্যাংক আমানতের সুদের তুলনায় অনেক বেশি মুনাফা থাকায় কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়ে চলেছে। এর ফলে সরকারের সুদব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের স্কিমগুলোর মুনাফার হার কমানোর দাবি ছিল বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের। অর্থমন্ত্র্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বছরের বাজেট ঘোষণার আগে একবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর ইঙ্গিত দেন। এবারও একবার এমন কথা বলেছেন গত মে মাসে। সর্বশেষ গত ৮ জুন বাজেট প্রস্তাব-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার সব সময় এক রকম থাকবে এমন না। এটা দুই-তিন বছর পরপরই পর্যালোচনা করা হয়। এবার এটা পর্যালোচনা করতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বাজেটের মাসে অথবা পরের মাসে এটি পর্যালোচনা করা হবে। ’
সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর আভাসের পাশাপাশি নতুন সংকট এসে উপস্থিত হয়েছে আমানতের সুদহার কমিয়ে আনা। গত ২০ জুন ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) প্রতিনিধিরা এক বৈঠকে আমানতের সুদের হার কমিয়ে সর্বনিম্ন ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন, যা গতকাল সোমবার থেকেই কার্যকর হওয়ার কথা। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকের পর ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরাও সুদহার কমাতে রাজী হয়েছেন। সব কিছু মিলিয়ে সময়টা এখন সঞ্চয়ীদের জন্য কিছুটা জটিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত; জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর মুনাফা প্রদান করে সরকার। মেয়াদপুর্তির পরে বিনিয়োগকৃত অর্থও ফেরত প্রদান করা হয়। প্রতিমাসে বিক্রি হওয়া সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে প্রাপ্ত বিনিয়োগের হিসাব থেকে আগে বিক্রি হওয়া স্কিমগুলোর মূল ও মুনাফা বাদ দিয়ে নিট ঋণ হিসাব করা হয়। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আলোচ্য ১১ মাসে সঞ্চয় স্কিমগুলোর মধ্যে বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে। এ খাতে গত ১১ মাসে নিট ঋণ এসেছে ১৪ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর পরে রয়েছে তিন-মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, নিট ঋণ ১০ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে নিট ঋণ এসেছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। পাঁচ-বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে নিট ঋণ এসেছে ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। তাছাড়া মেয়াদি হিসাবে জমাকৃত অর্থ রয়েছে ৬ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে নিট ঋণ আছে এক হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা।
আসন্ন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমাতে পারে। এ কারণে এ খাতের সঞ্চয়স্কিমগুলোর মুনাফার হার কমারও আশঙ্কা করছেন অনেকে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেও এর ঈঙ্গিত পাওয়া গেছে। যে কারণে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে সঞ্চয়পত্র কেনার হিড়িক পড়েছে ব্যাংকে। গত সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন কর্মদিবসে বিপুল সংখ্যক গ্রাহককে সারি ধরে দাঁড়িয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে দেখা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে।
২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরণের সঞ্চয়পত্রে ২ শতাংশ করে কমানো হয়। এরপরও সঞ্চয়পত্রগুলোর মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। পেনশন সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ বছরমেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন মাস-অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তিন বছরমেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ।