স্বপ্ন পূরণের জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান অনেকেই। অক্লান্ত পরিশ্রম করে যা রোজগার করেন সেটাও পাঠিয়ে দেন দেশে। শত কষ্ট, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা সহ্য করে আপনজনের মুখে হাসি ফোটানোর তাগিদে দিনের পর দিন কলুর বলদের মত খেটে চলেছেন তারা। সেই মানুষগুলোর সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরেছেন রিফাত কান্তি সেন-
দেশে কাজ না পেয়ে অনেকেই ছুটছেন প্রবাসে। দেশের মায়া-মমতা ত্যাগ করে আপনজনের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ভিনদেশে কষ্টের জীবন। রমজান মিয়া (ছদ্মনাম) থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে। ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবই আছে তার। সংসারের হাল ধরতে গিয়েছেন বিদেশে। নিজের ভাগ্য বদলের আশায় প্রবাস জীবন বেছে নিলেও ভাগ্য তার সঙ্গে করছে নিষ্ঠুর আচরণ। অর্থ উপার্জন করলেও তার মাঝে নেই সুখ। চাপা কষ্ট বিরাজ করছে তার মনে।
ছেলে এবার মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। ছেলের বায়নার শেষ নেই। এটা দাও, ওটা দাও- কত রকমের বায়না। বেচারা বায়না মেটাতে মেটাতে অস্থির। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও সন্তানদের মানুষ করার জন্য সব বায়না মেনে নেন। মেয়ে এবার মাধ্যমিকের ছাত্রী। বায়না তারও কম নয়। আর স্ত্রী তো মনে করেন, তিনি টাকার মেশিন। মাস শেষ না হতেই ফোন আর ফোন। বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয় থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব কতজনের আবদার যে এখন রমজান আলীকে মেটাতে হয়, তার খবর কে-ই বা রাখে। অথচ সবার আবদার মেটাতে গিয়ে বহু বছর দেশে ফেরা হয়নি তার।
অনেক বন্ধু এখন আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করে না। হয়তো আবদার মেটাতে পারেননি! এমনকি অনেক আত্মীয়-স্বজন দিন-রাত গালাগালি করেন। কিন্তু মানুষটি ভালো আছে কিনা সে খবর কেউ জানতে চায় না। একমাসে টাকা না পাঠালে স্ত্রী-সন্তানদের অভিমান চরমে। বেতন পেয়েছে কিনা, সে খবর নেয় না। প্রয়োজনে ধার করে হলেও টাকা পাঠাতে হবে। সন্তান-পরিজন সবাই মিলে দেশে স্ফূর্তিতে থাকলেও বিদেশের মাটিতে রমজান আলী আছেন অনেক কষ্টে।
শুধু কি বিদেশেই কষ্ট? এবার দেশের কষ্টের কথায় আসা যাক। এক দশক পর দেশের মাটিতে পা রেখেছেন তিনি। লাগেজ ভর্তি মালামাল। এয়ারপোর্টের ঝক্কি-ঝামেলা সামলে বাড়ি ফেরার পালা। সবার মুখে একটিই প্রশ্ন, কী এনেছেন তিনি! কেউই জিজ্ঞেস করেনি, সে কেমন আছে!
বাড়ি ফেরার পর সবার চাহিদা অনুযায়ী জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়ে শূন্য লাগেজটাই সঙ্গী হিসেবে নিয়েছেন তিনি। বুক ফেটে কান্না আসে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে কাঁদতেও পারেন না। কতজন যে অনুদানের জন্য ভিড় জমায়। আসলেই কি তিনি দাতা হয়ে গেছেন? তিনি বিদেশ করছেন বলে কি মহাকাশটা কিনে ফেলেছেন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় তার মনে। কিন্তু সমাজের কাছে ছোট না হতে চাইলে তো আবদার মেটাতেই হবে। তা যেভাবেই হোক।
কারো সঙ্গে দেখা হলেই তাকে জিজ্ঞেস করে, কবে আবার ফিরবে বিদেশের মাটিতে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন তিনি। যে মাটির টানে বহু বছর পর দেশে ফিরেছেন। আলো-বাতাসে নিজের দেহটাকে ভাসিয়েছেন। যে দেশটার জন্য হাজার হাজার টাকা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছেন। সে দেশের লোকেরাই কিনা তাকে বলছে, এ দেশ ছেড়ে কবে যাবে ভিনদেশে। তিনি যেতে চান না। একথা কেবল একজনই বোঝেন। তিনি তার মা। মা বলেন, ‘বাবা তোর আর বিদেশ যাওনের দরকার নাই। তুই দেশেই থাইকা যা।’
এবার আরেক তরুণের কথা জানা যাক, তিনি আবদুর রহিম (ছদ্মনাম)। দেশে চাকরি না পেয়ে গিয়েছেন প্রবাসে। টাকা কামাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু এতে নেই কোনো তৃপ্তি। ঘরের বড় ছেলে বলে সব টাকা সংসারের পেছনেই ব্যয় করছেন। দেখতে দেখতে আট বছর হয়ে গেল।
দেশে থাকতে ভালোবাসতেন গ্রামের নীলা আক্তার (ছদ্মনাম) নামে এক তরুণীকে। স্বপ্ন সাজাতে গিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন দূর প্রবাসে। যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ভালো ঘরে বিয়ে হয়ে যায় নীলার। দেশে ফিরে দেখা করতে চান তার সঙ্গে। পরিবার-পরিজনের চাহিদা মিটিয়ে নিজের জীবনটা শুধু শূন্যের খাতায়ই রেখে দিয়েছেন। প্রবাস জীবনের কষ্টের কথা কাউকে না বললেও এবার মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন, আর যাবেন না বিদেশে। এ খবর পরিবারে জানাজানি হলে শুধু মা-ই বলেছিলেন, ‘থেকে গেলে হয় না বাবা’। অন্যদিকে স্বার্থপর মানুষগুলো দূরে ঠেলে দিতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
প্রবাসীদের যেন স্বপ্ন থাকতে নেই। টাকার পেছনে ছুটে বড় ক্লান্ত তারা। নিজ দেশে, নিজ মাটিতে এসে একটু শান্তির পরশ পেতেও বাধা। বছরে দু’বার ঈদ এলেও যেন বিষাদময় হয়ে ওঠে প্রবাসীদের জন্য। সবাইকে রেখে ঈদ উদযাপন করা খুবই কষ্টের। ঈদ ঘনিয়ে এলেই টাকা পাঠানোর চাপ বাড়তে থাকে। মানুষগুলো দিনের পর দিন শুধু খেটেই যাচ্ছেন, বিনিময় পাচ্ছেন লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা।
এর বাইরে হয়তো অনেক সুখের গল্প থাকতে পারে। কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকদের মনে কখনোই কি সুখ আসে? তবুও বলবো- প্রবাসীরা ভালো থাকুক। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সেই আমাদের অর্থনীতির চাকা হবে বেগবান। আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবো।
লেখক: শিক্ষক ও কথাশিল্পী