মহাজোটে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এরশাদ বিএনপিতে জামান

নিউজ ডেস্ক:: অভিজাত গুলশান-বনানী-বারিধারা ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সমন্বয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসনটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে ভোটের লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হেভিওয়েট প্রার্থী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্য রাজনৈতিক দলের একাধিক প্রার্থী।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট একসঙ্গে ভোটে গেলে মহাজোটের প্রার্থী হবেন এরশাদ। তখন লড়াই হবে এরশাদের সঙ্গে বিএনপি প্রার্থীর। আর দলগুলো আলাদা নির্বাচন করলে এ আসনে লড়াই হবে ত্রিমুখী। আগেও এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ।

এর আগে দুই দফা নির্বাচনে তিনি মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান ও ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমএ কাদের খান। হাইকমান্ডের সবুজ সংকেত পেয়ে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কামাল জামান।

শুরুতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও জামানকে সবুজ সংকেত দেয়ার খবরে তিনি অনেকটা নীরব হয়ে গেছেন। তারপরও মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। এ আসন থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর (অব.) কামরুল ইসলামের নাম শোনা গেলেও তিনি ঢাকা-১৮ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানান।

অন্যদিকে দ্বিতীয়বারের মতো মহাজোটের সমর্থনের অপেক্ষায় এ আসনের বর্তমান এমপি ও বিএনএফ’র চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল এলায়েন্স-বিএনএ তথা জাতীয় জোট ও তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। রাস্তাঘাটের সংস্কারসহ নানা খাতে উন্নয়ন হলেও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আধিক্য ও যানজটসহ নানা সমস্যা ম্লান অভিজাত এলাকার মহিমা।

অন্যদিকে এই আসনের অন্তর্গত ৭তলা বস্তি, কড়াইল বস্তি, ভাসানটেকের মতো এলাকায় রয়েছে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের বসবাস। এসব বস্তি ঘিরে মাদকের রমরমা বাণিজ্যের অভিযোগ বিস্তর।

জানা যায়, ২০০৮ সালে ভোটের আগ পর্যন্ত এলাকাগুলো ঢাকা-৫ আসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে এমপি হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, পরের দফায় ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে এমপি হন বিএনপির মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম, ৭ম সংসদে এমপি হন আওয়ামী লীগের একেএম রহমতুল্লাহ, ৮ম সংসদে ফের এমপি হন কামরুল ইসলাম।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্বিন্যাসের পর গঠিত ঢাকা-১৭ আসনটি মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়। বিএনপির প্রয়াত নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহকে হারিয়ে এমপি হন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

২০১৪ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ আসনটি এরশাদকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এরশাদ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ায় এমপি হয়ে যান বিএনএফের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ।

জাতীয় পার্টি : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জোটগত হলে এ আসনে মহাজোটের প্রার্থী একজনই। তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সাবেক এই রাষ্ট্রপতি এরই মধ্যে ঢাকা-১৭ আসন থেকে নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছেন। অনেক জনসভাও করেছেন তিনি। ফেব্র“য়ারিতে ঢাকা-১৭ নির্বাচনী এলাকার ভাসানটেক বাজার, দামালকোর্ট এবং কচুক্ষেতে পৃথক তিনটি জনসভা করে জাতীয় পার্টি। প্রতিটি জনসভায়ই দলের চেয়ারম্যান এরশাদ প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন।

নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে কথা হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে এ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। এটা আমারই আসন। এখানকার জনগণ আমাকেই প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চায়। তিনি বলেন, আমি আগেও এলাকার মানুষের সঙ্গে ছিলাম। অনেক উন্নয়ন করেছি। আমাকে সব সময় কাছে পেয়েছেন। বর্তমান এমপিকে মানুষ খুঁজে পায় না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, গণতন্ত্রের মূল বক্তব্যই হল নির্বাচন। জাতীয় পার্টি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আর গণতন্ত্রের মূল শক্তি জনগণ। সেজন্যই আমি এই আসনের জনগণের কাছে গিয়েছি। তাদের সমর্থন নিয়ে আমি এ এলাকা থেকে নির্বাচন করতে চাই। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন, আমার সময়ে খুন-গুম ছিল না, মানুষ শান্তিতে ছিল, আবার শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাই। আমি বড়লোকের রাজনীতি করি না, গরিবের রাজনীতি করি। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে চাই। আগামী দিনে আবার নির্বাচন করতে চাই।

আওয়ামী লীগ : এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এলাকায় নাম শোনা যাচ্ছে ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমএ কাদের খানের। নির্বাচন সামনে রেখে আগে থেকেই তৎপর তিনি। নিয়মিত গণসংযোগ করা ছাড়াও সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তিনি। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। স্থানীয় হওয়ায় সব পেশার মানুষের সঙ্গেই রয়েছে তার সুসম্পর্ক।

জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের খান বলেন, দলীয় প্রার্থী দেয়া হলে তাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে। দলের হাইকমান্ড সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করি।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন এ আসনে দলীয় এমপি না থাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ আছে। আশা করি, আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হবে। আমাকে প্রার্থী করা হলে নৌকার জয় উপহার দিতে পারব।

কাদের খান ছাড়াও এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান। তিনি বলেন, গোপালগঞ্জ-১ থেকে চারবারের এমপি আমি। সেখান থেকেই ভোট করতে চাই। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে দলের নেতাকর্মীরা আমাকে ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে আগ্রহ দেখান।

বিএনপি : কূটনৈতিক জোন ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভোটারদের কথা বিবেচনায় রেখেই প্রার্থী চূড়ান্ত করবে বিএনপি। দলের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন ব্যবসায়ী নেতা কামাল জামান। হান্নান শাহ মারা যাওয়ার পর এ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী সংকটে পড়ে বিএনপি। গুলশান ও বনানী এলাকায় দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের বসবাস।

সেদিকে থেকে বিবেচনা করে ব্যবসায়ী নেতা জামান এ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেন। বিএনপির হাইকমান্ডের সুনজরে আছেন তিনি। দলের সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি এখন নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এলাকার পেশাজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করছেন। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে গুলশানে বসবাসের কারণে প্রত্যেকের সঙ্গেই তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। গুলশান সোসাইটিরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন তিনি।

জানতে চাইলে জামান বলেন, দলের নির্দেশনা পেয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করছি। মহানগর নেতাদের সঙ্গেও কথা হচ্ছে। প্রতিদিনই নানা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। শুধু নির্বাচনী এলাকা নয়, দেশের যে কোনো অঞ্চলের নেতাকর্মীদের নানাভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, দুই যুগ ধরে গুলশান এলাকায় বসবাসের কারণে সবার সঙ্গেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অভিজাত মানুষের পাশাপাশি এলাকার বস্তিবাসীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। তাদের বিপদে সাধ্যমতো সহযোগিতার চেষ্টা করি। জামান বলেন, আমাকে মনোনয়ন দেয়া হলে আসনটি চেয়ারপারসনকে উপহার দিতে পারব বলে আশা করি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরীও নির্বাচন করতে আগ্রহী। একসময় তিনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলেও এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়।

অন্যান্য দল : মহাজোটের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী তৃণমূল বিএনপি এবং দলটির নেতৃত্বাধীন বেশ কয়েকটি দলের জোট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স’র চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা। অনেক আগেই তার জোটের ১৪ দলীয় জোটে যোগ দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।

কিন্তু ১৪ দলের মূলনীতির সঙ্গে তৃণমূল বিএনপির গঠনতন্ত্রে আদর্শিক বিশ্বাস সাংঘর্ষিক হওয়ায় তারা এ জোটে যোগ দিতে পারেননি। পরে সিদ্ধান্ত হয় তার দল ও জোট নির্বাচনী জোট তথা মহাজোটে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে।

জানতে চাইলে নাজমুল হুদা বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এ আসনে কাজ করতে বলেছেন। সে অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *