সৌদি ফেরত নারীদের কান্না

নিউজ ডেস্ক:: কাজের কথা বলে নিয়ে গেছে। কিন্তু যাওয়ার পর নির্যাতন (যৌন নিপীড়ন) করতে চেয়েছে। তাতে রাজি না হওয়ায় ছাদে নিয়ে গেছে। বেধড়ক মারধর করেছে। একপর্যায়ে ছাদ থেকে ফেলে দিছে। এতে পা ভেঙে গেছে।

এই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সুস্থ হলে আবারো তাকে নির্যাতন করা হবে। ফেরত না আনলে মেয়েকে মেরেই ফেলবে তারা। এসব কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন সম্প্রতি সৌদি আরবে নিপীড়নের শিকার এক নারীর মা। ষাটোর্ধ্ব এই মা আকুতি জানিয়ে বলেন, আপনারা আমার মেয়েকে এনে দেন।

গতকাল দুপুর ১২টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই আকুতি জানান। বলেন, তার তিন বছরের সন্তান বাড়িতে। তার অবস্থাও ভালো না। তিনি বলেন, আজকে কতদিন ধরে মেয়েটা বিপদে। বিভিন্ন অফিসে যাচ্ছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না। উল্টো মেয়ের জামাইকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেশন (বিএসএসএম) আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে ব্রাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ওয়ারবি ফাউন্ডেশন, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট ফর রিসার্চ ইউনিট (রামরু), বাংলাদেশি অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বমসা), অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকুপ), মানুষের জন্য ফাইন্ডেশন, আওয়াজ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ অভিবাসী অধিকার ফোরাম (বোয়াফ) সহ ১১ বেসরকারি সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন সম্মেলনে অংশ নেয়। এর আগে বেলা ১১টার দিকে একই ইস্যুতে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে তারা। এ সময় নেতৃবৃন্দ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত দেশটিতে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ রাখার দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসা বেশ কয়েকজন নারীকর্মী তাদের ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করেন। নির্যাতিত নারীরা অভিযোগ করেন, যেসব এজেন্সি তাদেরকে সৌদি আরবে পাঠায়, তারা পরবর্তীতে সমস্যার কথা জানালে পাত্তা দেয় না। বলে, বিমানবন্দর পার করে দেয়ার পরই তাদের দায় শেষ।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিনা রায়। তিনি জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় হাজার খানেক নারী গৃহকর্মী দেশে ফিরেছেন। দেশে ফেরার অপেক্ষায় সেখানে সেউফ হাউজ ও জেলে আছেন আরো অনেকে। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দেশে ফিরে আসা নারীরা তাদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা দিচ্ছেন। তাতে অধিক সময় ধরে কাজ করানো, সময় মতো ঘুমাতে না দেয়া, ঠিকমতো খাবার না দেয়, মাস শেষে নির্ধারিত বেতন না দেয়া, গৃহকর্তা এবং বাড়ির অন্যদের দ্বারা ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ যৌন নির্যাতনের ফলে গর্ভবতী হয়ে দেশে ফিরে আসার মতো ঘটনাও আছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ফেরত আসা নারীরা জানিয়েছে, এসব প্রতিবাদ করলে মধ্যযোগীয়পন্থায় নির্যাতন চলে। গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া, মাথায় গরম পানি ঢেলে দেয়া, চুল টেনে তুলে ফেলা, গরম আয়রন দিয়ে সেঁকা দেয়া, খুন্তি গরম করে শরীর পুড়িয়ে দেয়াসহ খাবার ও পানি ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে গৃহবন্দি করে রাখার মতো ভয়াবহ নির্যাতনও তাদের ওপর চালানো হয়েছে। ফলে অনেকেই ফিরেছেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। আবার নির্যাতিতদের অনেকের পরিবার তাদেরকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ। নারী কর্মীদের নির্যাতনের ঘটনা খুব কম, সরকারের এমন বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়, একটি মেয়েও যদি নির্যাতিত হয় তার জন্য ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি। কিন্তু সেই ধরনের ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়, প্রবাসী বা নারী কর্মীরা শুধু টাকা পাঠানোর মেশিন নয়। সবার আগে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি। সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- সৌদি আরবসহ বিদেশে কাজ করতে যাওয়া প্রত্যেক নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত, ফেরত আসা গৃহকর্মীর ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য সেবা ও প্রাপ্য মজুরি নিশ্চিত, গৃহকর্মী বা গন্তব্য দেশের এজেন্সি কর্তৃক গর্ভবতী নারী শ্রমিক ও তার শিশুর সম্পূর্ণ দায়িত্ব বহন, দোষী গৃহকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দূতাবাসের কার্যকরী ভূমিকাসহ যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, ওয়ারবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক, ব্রাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান, রামরু’র মেরিনা সুলতানা, ওকুপ-এর নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক চৌধুরীসহ মানবাধিকার সংস্থার নেতৃবৃন্দ। শরিফুল হাসান বলেন, ২০১৫ সালে যখন নারী কর্মী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় তখনই আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছিলাম, তারা আশ্বাসও দিয়েছিলো, কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেখানে আল্লাহ ছাড়া তাদের দেখার কেউ নেই। ওমর ফারুক চৌধুরী সম্প্রতি করা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তার মন্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী বলেছেন, ২-৩ শতাংশ এমন ঘটনার শিকার হতে পারেন। ওমর ফারুক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি এমন স্টেটমেন্ট কিভাবে দিতে পারেন? তার এই কথার মাধ্যমে বোঝা যায় কারা দালালদের পৃষ্টপোষকতা করছে। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধের দাবি জানান। সুমাইয়া ইসলাম বলেন, নারী কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে যে সমঝোতা স্মারক হয়েছে তার কোনোটিই সৌদি মানেনি।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনের আগে বেলা ১১টার দিকে একই ইস্যুতে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করা হয়।

এতে সৌদি আরবে নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ব্রাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ফরহাদ আল করিম, আওয়াজ ফাউন্ডেশনের আনিচুর রহমান, ওয়ারবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক, মহাসচিব ফারুক আহমেদ, রামরুর মেরিনা সুলতানা প্রমুখ। বক্তারা অবিলম্বে নির্যাতন বন্ধে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানান।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *