সোলেমান ইসলাম তাওহীদ এর রক্তবিন্দু

মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সাধারণ একটি ছেলে জাবেদ। পরিবারে মা, বড় ভাই তার স্ত্রী ও সে। বাবা মারা গেছে প্রায় ৭ বছর। বড় ভাই আবির ঘরের বড় ছেলে হওয়ায় বাবা মারা যাবার পর থেকে সেই সংসারের ভরণপোষণ করে আসছে। জাবেদ কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশোনা করে, ডাক্তার হবে বলে বড় ভাই আবির। যে কোনো ভাবে তার পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাবে। জাবেদ পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটখাটো একটা পার্ট টাইম জব করে। এভাবেই চলছে তাদের পরিবারে দৈনন্দিন জীবন।

জাবেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সাথে অধ্যয়নকারী একটি মেয়েকে ভালোবাসে, নাম ঈশা। বলতে গেলে দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ঈশার বাবা ধনী ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তার জীবন-যাপন ও বিলাসবহুল। তবে ঈশার এই বিলাসিতার কোনো অহংকার নেই সে জাবেদের সাথে এমন কোনো আচরণ করে না যাতে জাবেদ কষ্ট পায়। এক পর্যায় তাদের ভালোবাসাটা এতোটা গভীর হয়ে যায় যে এক মুহূর্তও একজন আরেকজন কে ছাড়া থাকতে পারে না। এভাবে চলতে থাকে তাদের গভীর ভালোবাসা।

একদিন জাবেদ ভার্সিটি থেকে ফিরে বাসায় এসে দেখে মা এবং ভাবী কান্নাকাটি করেছে।
জাবেদ মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- কি হয়েছে?
মা কান্নারত অবস্থায় বলল- তর ভাই (আবির) শরীর ভীষণ খারাপ সকালে তুই যাবার পর অফিসে উদ্দেশ্য রওয়ানা হওয়ার সময় বাড়ি রাস্তায় হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এ সময় তাকে লোকজন এসে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়। তারপর অবস্থা খারাপ দেখে তাকে আমি আর তর ভাবী মেডিকেলে নিয়ে যাই।
ডাক্তারা বলছে- তাকে (আবির) মেডিকেল অব্জারবেশনে রাখতে হবে এবং ১ মাসের মধ্যে অপারেশন করতে হবে।
মা- এখন বুঝলাম না বাবা তার কি হয়েছে যে অপারেশন করতে হবে।
জাবেদ- আরে কি বলতেছো মা, ভাইয়ার আবার কি হইবে। চলতো… মেডিকেলে…

মেডিকেলে গিয়ে জাবেদ প্রথমে ভাইয়ের সাথে দেখা করল তারপর ভাবী এবং মা কে ভাইয়ের কাছে রেখে সে ডাক্তার এর কাছে গেলো বিস্তারিত জানার জন্য।
ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ডাক্তার বলল- আপনার ভাইয়ের (আবির) ব্রেইন টিউমার ধরা পরছে। কয়েকদিনের মধ্যে অপারেশন না করলে সে মারা যেতে পারে। ব্রেইন টিউমারটি ধরা পরেছে অনেক আগে। কিন্তু সে ঠিক সময় মত ট্রিটমেন্ট না করায় তার অসুস্থতার মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। এখন অপারেশনের জন্য ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা প্রয়োজন।
জাবেদ চিন্তা করতে লাগলো যে তার বড় ভাই আবির তাদের কাছে তার অসুস্থতার কথা কেন লুকিয়েছে।
এরপর। জাবেদ একটাই চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে বড় ভাইকে বাঁচাবে আর এ কয়েকদিনের মধ্যে এতোগুলো টাকা কোথায় পাবে? আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো না। অসহায় পরিবার এখন নিরুপায়। অবশেষে, জাবেদের কাছের একটা
বন্ধু বললো- দেখ জাবেদ তোর এই বিপদের সময় একটাই পথ খুলা আছে।
জাবেদ- কি?
বন্ধু- ঈশাকে সব খুলে বল। আমার মনে হয় এই বিপদের সময় ঈশা একমাত্র তোকে হেল্প করতে পারে। জানি তুই কখনো কারো কাছে হাত পাতাসনি কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। এই জন্য বললাম, ঈশা তোর গার্লফ্রেন্ড। তুই এখন, আমার কথা ভেবে দেখতে পারিস।

অনেক ভেবে-চিন্তে ঠিক করলাম ঈশার বাসায় যাব। ঈশাকে একটা ফোন দিয়ে কনফার্ম হয়ে নিলাম- কাল ফ্রী আছে কি না? জাবেদ ঈশার বাসায় হাজির। কারণ, ঈশার পরিবার জাবেদকে অনেক আগে থেকে চিনে। জাবেদকে ঈশা তার রুমে নিয়ে গেল।
এরপর।
ঈশা বলল- তোমার জন্য কফি নিয়ে আসি।
কিছুক্ষণ পর, কফি খেতে খেতে
ঈশা বলল- জাবেদ তুমি ভার্সিটিতে আসছ না, তোমাকে ফোনেই পাই না। কি অইছে তোমার?
জাবেদ- কিছু না। কয়েকদিন যাবত ভাবছি তোমাকে একটা কথা বলব।
ঈশা- কি বল? এনি প্রবলেম?
জাবেদ- না… তেমন কিছু না। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। তুমি যদি আমাকে কিছু টাকা দিয়ে হেল্প করতে পারতে…
ঈশা- হঠাৎ টাকার চাওয়ার… কারণ কি?
জাবেদ- আমি এখন খুব বিপদে আছি। আমার কাছে এক সপ্তাহের সময় আছে, এই সময়ের মধ্যে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দরকার। না হলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।
ঈশা- ঘটনা কি খুলে বলো? দেখি কোন ব্যবস্থা করতে পারি কিনা?
জাবেদ- তোমাকে আমি পরে সব কথা খুলে বলব। প্লিজ… তুমি আমাকে টাকা মেনেজ করে দাও।
জাবেদ কোনভাবে ঘটনা খুলে বলে না কিন্তু ঈশা জানতে চায় কেন? টাকা দরকার।

ঈশার মনে পরে যায়- ঈশার খুব গনিষ্ঠ বান্ধবী রিয়া। রিয়াও ছিল খুব ধনীর ঘরের মেয়ে। রিয়া একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। জাসিম ছিলো মধ্যবিত্ত পরিবারে, ছেলেটির নাম জাসিম। ওদের সম্পর্ক চলতে থাকে টানা ২ বছর। একদিন জাসিম ঠিক করে ফেলো রিয়াকে বিয়ে করবে। কিন্তু বিয়ে করার আগে রিয়ার কাছে কিছু টাকা চায় জসিম। অবশেষ জাসিম রিয়াকে অনেক বুঝানোর পর রিয়া বিয়ে করতে রাজি হয়। তারা ঠিক করল যে পালিয়ে বিয়ে করবে।

জাসিম – তুমি বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তোমার কিছু জিনিসপত্র আর টাকা’টা নিয়ে বের হবে। আর আমারা আমার বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠব।
যা কথা সেই কাজ, রিয়া রাতেই সবকিছু নিয়ে নিল তার সোনা-গয়না, কপড়-চোপড়। ফজরের আযান হলো। ভোর হলো। বেরিয়ে পরলো বাসা থেকে জাসিমর সাথে দেখা করে তারা বাস টার্মিনাল চলে যায়।
জাসিম- তুমি সব কিছু নিয়েছ তো।
রিয়া- হে! ব্যাগে আমার সব সোনা-গয়না, কাপড়-চোপড় আছে।
জাসিম- ব্যাগ তো এখানে দু’টো কোনাটাতে তোমার সোনা-গয়না।
রিয়া- ওই ব্যাগে আছে।
জাসিম- ঠিক আছে ব্যাগটা আমার কাছে দাও। এখানে সেফটি না।
রিয়া- ঠিক আছে ধরো।
জাসিম- আমি বাসের টিকেট নিয়ে আসি।
এই বলে জাসিম চলে যায়। আর জাসিম ফিরে আসে না। অন্যদিকে রিয়ার অনেক খুঁজাখুঁজি করে জাসিমকে আর পায়নি। সে পর্যন্ত রিয়া তার বাসায় ফিরে যায়। এরপর তার পরিবারকে সব কথা খুলে বললো এবং তার ফ্রেন্ড ঈশাও জানতে পারলো সব ঘটনা।

ঈশা- আমি তোমাকে একটাও টাকা দিতে পারবো না।
জাবেদ- কেন? কেন দিতে পারবে না।
ঈশা- তোমাকে আমার সন্দেহ হচ্ছে…
ঈশা ও জাবেদের অনেকক্ষণ পর্যন্ত তর্কবিতর্ক চলতে থাকে। জাবেদ রেগে গিয়ে ঈশাকে চড় মেরে ফেলল। আর টেবিলের ওপর নতুন ফল কাটার ছুরি রাখা ছিল। ওই ছুরিতে পড়ে গিয়ে ঈশার গলাটা কেটে যায়। সেখানে ঈশা মারা যায় এবং টেবিলে রাখা একটি চা’র কাপ ভেঙ্গে যায় এবং অন্য কাপটি অক্ষত থাকে। চায়ের কাপের শব্দে পেয়ে ঈশার মা চলে আসে বেডরুম এসে দেখতে পান তার মেয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে আর রক্তাত ফ্লোর। জাবেদও লাশের পাশে আর জাবেদের গায় রক্ত। এসব দেখে ঈশার মা চিৎকার শুরু করলেন এবং ঈশার বাবা এসে দেখেও ফেলেন। জাবেদ পালিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু ঈশার বাবা তাকে ধরে ফেলেন। অবশেষে ঈশার মা-বাবাকে জাবেদ খুন করে বসেল। এরপর জাবেদ বাসা থেকে বের হওায়ার আগে মুহূর্তে মনেপরে – যখন মাডার করেছি তখন সবকিছু নিয়ে বাসা থেকে যাবো। জাবেদ ওই বাসা থেকে টাকা-পয়সা ও দামী সব জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে পরলো। কিন্তু কেউ দেখতে পাইনি জাবেদকে বের হয়ে যেতে। আর ওই বাসায় মাডার হয়েছে কেউ জানতে পাইনি আর দেখতেও পাইনি।

জাবেদের একটাই চিন্তা ছিল তার ভাইকে (আবির) বাঁচাবে। আর ওই টাকা দিয়ে (আবির) ভাইকে অপারেশন করে (আবির) ভাইকে সুস্থ করে তোলো। কিন্তু
জাবেদের পরিবার বলল- তুই এতো টাকা কোথায় পেয়েছিস। আমাদের মত সাধারণ ঘরের ফ্যামিলি সারা বছর খাটলে একসাথে এতো টাকা জোগাড় করতে পারবে না। এতো কম সময়ের মধ্যে এতো টাকাগুলো কিভাবে করলি জোগাড় বাবা?
জাবেদ বলল- আম্মা আমি তোমাকে সব পরে খুলে বলব। এখন বলার সময় নয়।
এভাবে চলে যায় ২ সপ্তাহ। জাবেদের ভয় আরও বাড়তে লাগলো। সে জানে ঈশা ও তার পরিবারের খুনের তদন্ত করছে পুলিশ। অন্যদিকে জাবেদের ভাই (আবির) সুস্থ হতে লাগলো। হঠাৎ একদিন জাবেদের বাসায় পুলিশ আসে।
পুলিশ এসে বাসায় জিজ্ঞাসা করল তার মা’কে- আপনি কি জাবেদের মা।
মা – জী!
পুলিশ – জাবেদ কি বাসায় আছে?
মা – জী! কিন্তু কে?
পুলিশ – আপনার ছেলেকে ডাকুন। দরকার আছে?
মা – জাবেদ এদিকে আয়তো বাবা।
জাবেদ এসে পুলিশকে দেখে নির্বাক অবস্থা।
পুলিশ – তাকে নিয়ে চলো আর আপনি আমাদের সাথে থানায় আসুন।
জাবেদ – স্যার! আমি কি দোষ করেছি। স্যার! আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। স্যার! স্যার!
জাবেদকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।
মা – স্যার! আমার ছেলেকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? আমার ছেলে কি দোষ করেছে?
পুলিশ – আপনার ছেলে ৩টি মাডার/খুন করেছে। এ জন্য তাকে আমার ধরে নিয়ে যাচ্ছি।
মা – না! না! আমার ছেলে মন কাজ করতে পারে না। স্যার! আপনাদের কোন সমস্যা হচ্ছে। কি রে জাবেদ তুই সত্যি খুন করেছিস।
পুলিশ – থানায় নিলে সব স্বীকার করবে। নিয়ে চল।
অবশেষ থানায় জিজ্ঞাসাবাদে। আপনার ছেলের সব বন্ধুদের হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট করিয়েছি তাদের কোন মিল পাওয়া যায়নি। সবশেষ আপনার ছেলের ডিএনএস টেস্ট ও ফিঙ্গার প্রিন্ট রিপোর্টে মিল আছে তার সব কাহিনীর। অই ওই বাড়ির খুন হয়ে যাওয়া- ঈশার রুমে ঈশার গালে ও মা-বাবার শরীরে ফিঙ্গার প্রিন্ট রিপোর্টসহ  এবং একটি চায়ের কাপের ডিএনএস টেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী জাবেদ ধরা পরে। সব রিপোর্ট গুলো জাবেদ এবং তার মাকে দেখানো হয়। এরপর জাবেদ সবকিছু ঘটনা খুলে বলে এবং স্বীকার করে ওই ৩টি খুন সে করেছে।

জীবনটাই নির্বাক। কি করে কি হয়েছে? সে নিজেই জানে না।

পরিস্থিতি এমনই নি এক জিনিস; যে পড়েছে,

সেই জানে কত কিছু না, অপ্রস্তুতি ভাবেই হয়েছে।

লেখক: সোলেমান ইসলাম তাওহীদ

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *