অজান্তে

সোলেমান ইসলাম তাওহীদ এর ছোট গল্প 'অজান্তে'

রাজনীতি একটি শব্দ, চারটি অক্ষর। ‘র’ ‘জ’ ‘ন’ ‘ত’ চারটি অক্ষরই যেন মিশে আছে তার রক্তে। তার নাম ইলিয়াস। রাজনীতি কি? তা সে বুঝতো না। কোন এক অঘটনের কারণে সে রাজনীতিতে যোগ দেয় এবং সমাজের প্রতিষ্ঠিত নেতা হিসাবে তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে।
কোন কারণ বশত সে তার কর্মীদের নিয়ে আল-ফালাহ হাসপাতালের মোড়ে মিটিং বসায়। মিটিং শেষে তার তিন বন্ধু। মারুফ, জাহিদ ও শামীমকে নিয়ে আরও ঘণ্টা খানেক সময় হাসপাতালের মোড়ে অবস্থান করে। অবশ্য তার বন্ধুরা অনেক সময় তাকে ইলিয়াস ভাই বলে ডাকে। সেই সময় ইলিয়াস সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট নিয়ে ধূমপান করে।
তার বন্ধুরা ইলিয়াসের সামনে ধূমপান করে না। তবে ইলিয়াস এর স্বভাব সে মানুষ-মুখী হয়ে ধূমপান করে না এবং সবসময় বা-হাতে সিগারেট থাকে। ইলিয়াস যখন ধূমপান করে তখন হাসপাতালের রাস্তার ভিতর দিয়ে ডা. সুস্মিতা রায় হেঁটে যাচ্ছিলো এবং তার সাথে থাকা বান্ধবী ডা. লিমা চৌধুরী ফোনে কথা বলছিল। তখন মারুফ ডা. সুস্মিতা রায় এবং লিমাকে দেখে বাজে মন্তব্য করে কিন্তু ইলিয়াস ডা. সুস্মিতা রায় এবং ডা. লিমা চৌধুরীকে দেখতে পায়নি।
তা সত্যেও ইলিয়াস মারুফের বাজে মন্তব্য শুনতে পেয়ে খুব বেশি রাগান্বিত হয়; বা-হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে মারুফকে বলে- ‘মেয়ে দেখলে কি জানে ই-য়ে চলে আসে’ আরও অনেক কিছু বলতে থাকে। যা ডা. সুস্মিতা রায় শুনতে পায় এবং ইলিয়াসের দিকে ফিরে তাকায়।
বেশ কয়েক দিন পর। ইলিয়াসের চোখের সামনেই রোড অ্যাকসিডেন্টে একটি মেয়ে খুব বেশি আহত হলে, সে মেয়েটির চিকিৎসার জন্য আল-ফালাহ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ছিল ডা. সুস্মিতা রায়। তখন ডা. সুস্মিতা রায় এবং ইলিয়াসের মধ্যে কিছু কথোপকথন হয়।
ডা. সুস্মিতা : মেয়েটি আপনার কে হয়?
ইলিয়াস : কেউ না। আমি আসার পথে দেখলাম, মেয়েটি রোড অ্যাকসিডেন্টে খুব বেশি আহত হয়েছে, তাই ভাবলাম মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা খুব জরুরী।
ডা. সুস্মিতা : খুব ভালো কাজ করেছেন।
ইলিয়াস : ধন্যবাদ!
ডা. সুস্মিতা : কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলি?
ইলিয়াস : কি বলবেন? বলেন।
ডা. সুস্মিতা : আচ্ছা, আপনার নামটা কি?
ইলিয়াস : ইলিয়াস আহমেদ।
এরই মাঝে ইলিয়াসের বেশ কয়েকজন বন্ধু ওই হাসপাতালে উপস্থিত হয়।
মারুফ : কি অইছে ভাই? কোন সমস্যা?
ইলিয়াস : না! কোন সমস্যা না। তোমরা এখানে কেন?
শামীম : না ভাই! আমরা খবর পাইছি আপনার কি যেন অইছে?
ইলিয়াস : আমার কি হবে? আমার তো কিছুই হয় নাই।
জাহিদ : তো কোন কাজে আসছিলেন?
ইলিয়াস : একটা মেয়ে রোড অ্যাকসিডেন্টে খুব আহত হইছে, তাই হাসপাতালে নিয়ে এলাম।
মারুফ : ও! ঠিক আছে ভাই।
এরই মাঝে বন্ধুদের সাথে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায় ইলিয়াস। অন্যদিকে ডা. সুস্মিতা রোড অ্যাকসিডেন্টে আহত মেয়েটির চিকিৎসা করছিল। ঠিক ঐ দিন বিকাল বেলায় ইলিয়াস রোড অ্যাকসিডেন্টে আহত মেয়েটির খুঁজ নেওয়ার জন্য হাসপাতালে আসে। তখন হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক ছিল ডা. লিমা চৌধুরী।
ডা. লিমা : আরে ইলিয়াস ভাই আপনি এখানে!
ইলিয়াস : হুম! তুমি কেমন আছো?
ডা. লিমা : ভালো আছি ভাইয়া। আপনি ভালো আছেন?
ইলিয়াস : ভালোই!
ডা. লিমা : ভাইয়া কিসের জন্য আসছেন?
ইলিয়াস : আচ্ছা! এই বেডে একটা মেয়ে ছিল।
ডা. লিমা : কোন মেয়ে?
ইলিয়াস : রোড অ্যাকসিডেন্টে আহত অইছিল মেয়েটা।
ডা. লিমা : ঠিক কয়টার দিকে ভর্তি করিয়ে ছিলেন ভাইয়া?
ইলিয়াস : প্রায় ১০:৩০ মিনিটের সময়।
ডা. লিমা : অহ! ঐ সময় এখানে তো ডা. সুস্মিতা রায় ছিল।
ইলিয়াস : হতে পারে। উনার সঙ্গে দেখা করা যাবে?
ডা. লিমা : প্লীজ! আসুন।
ডা. লিমা ইলিয়াসকে নিয়ে ডা. সুস্মিতার কাছে চলে যায়।
ডা. লিমা : উনি?
ইলিয়াস : হুম! আচ্ছা, ৬০৬ নং বেডের মেয়েটি কোথায়? আজ সকালে যে মেয়েটি রোড অ্যাকসিডেন্টে করছিল।
ডা. সুস্মিতা : ও তো তার গার্ডিয়ানের সঙ্গে চলে গেছে।
ইলিয়াস : ও! আচ্ছা আসি লিমা।
ডা. লিমা : ভালো থাকবেন ভাইয়া।
ইলিয়াস হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর।
ডা. সুস্মিতা : তুই উনাকে চিনোছ নাকি?
ডা. লিমা : হে! চিনিতো। তুই চিনোছ না।
ডা. সুস্মিতা : না!
ডা. লিমা : আরে সবাই তাকে চিনে, পলিটিকাল নেতা ইলিয়াস আহমেদ।
ডা. সুস্মিতা : দেখেইতো বুঝাই যায় না এতো বড় নেতা।
ডা. লিমা : আসলে উনি খুব ফ্রি মাইন্ডের মানুষ। যেকোন ধরনের বিপদে উনি আমাকে সাহায্য করেন। আমার খুব ফেভারিট মানুষ।
ডা. সুস্মিতা : আচ্ছা! তোর কাছে কি উনার মোবাইল নাম্বার আছে?
ডা. লিমা : হে আছে তো। কেন? তুই কি করবি?
ডা. সুস্মিতা : আরে ! আমার তো কখনো কোন বিপদ হতে পারে। তো নম্বরটা রাখলে ভালো হয় আরকি।
ডা. লিমা : হুম ঠিক আছে, ফোন নম্বরটা নে… ০১৭৮২…
ফোনে কথা বলে ডা. সুস্মিতা এবং ইলিয়াস খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে পরে। একদিন তারা দু’জন দেখা করতে যায়।
ডা. সুস্মিতা : কেমন আছো?
ইলিয়াস : ভালো। তুমি কেমন আছো?
ডা. সুস্মিতা : এইতো! আচ্ছা তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
ইলিয়াস : কি কথা?
ডা. সুস্মিতা : অনেকদিন হলো বলবো বলবো বলে বলতে পারতাছি না।
ইলিয়াস : আরে বল? এতো ইয়ে কতাছো কেন?
এর মাঝে ইলিয়াসের ফোন আসে। ইলিয়াস উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বাতাসের ধাক্কায় ইলিয়াসের প্যান্টের পিছনে থাকা পিস্তলটি ডা. সুস্মিতার চোখে পড়ে।
ডা. সুস্মিতা : আরে তোমার সাথে পিস্তল কেন?
ইলিয়াস : হা! হা! এটা কোন কথা হল? এটা আমার বেঁচে থাকার অস্ত্র।
ডা. সুস্মিতা : তুমি সামান্য পিস্তলকে বেঁচে থাকার অস্ত্র বলছো। বাঁচিয়ে রাখার মালিক তো ভগবান।
ইলিয়াস : তা ঠিক। এটা আমার সেফটির জন্য।
ডা. সুস্মিতা : কিসের সেফটি? তুমি এসব ছেঁড়ে চলে আসতে পারো না?
ইলিয়াস : না! কখনো না!
তখন ডা. সুস্মিতা অভিমান করে চলে যেতে যায়। ইলিয়াস ডা. সুস্মিতার হাত ধরে বলে-
ইলিয়াস : কিসের জন্য এই রাজনীতি করি জানো?
ডা. সুস্মিতা : না! কিসের জন্য?
ইলিয়াস : তাহলে শুনো আমার কাহিনী-
আমার বয়স যখন ১২ আর বোনের বয়স যখন ৮ তখন আমার মারা যান। তখন থেকে আমরা মায়ের আদরে বড় হয়েছিলাম। কিন্তু মাকেও বেশি সময় ধরে রাখতে পারিনি। আমার ১৫ বছর বয়সে মা মারা যান। তখন থেকে আমি এবং আমার বোন মামার বাড়িতে বড় হয়েছি। আমার বোনের নাম রূপা। আমি যখন ভার্সিটিতে পড়ছিলাম আমার বোন তখন ইন্টারে পড়ছে। ঠিক ঐ সময় একটি ছেলে আমার বোনকে ভালোবেসে ফেলে। প্রায় এক বছরের মতো প্রেম হয়। এক সময় ঐ ছেলেটি আমার বোন ধর্ষণ করে ব্রেকআপ করে দেয় এরপর আমার বোন একটা চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করে ফেলে। যা আমি সইতে পারিনি এরপর ঐ ছেলেটিকে খুন করি। খুনের সাজা ভোগ করে রাজনীতিতে পা দেয়া।
ডা. সুস্মিতা : ঠিক আছে আমি বুঝতে পারছি, তোমার মনের অবস্থা আর যদি আমার সাথে কখনো দেখা করতে হয় তাহলে পিস্তলটা সাথে নিয়ে আসবে না।
ইলিয়াস : আচ্ছা ঠিক আছে!
বিদায় নিলো ডা. সুস্মিতা, ইলিয়াস বাসায় ফিরে যায়।
২ দিন পর। ইলিয়াসের বন্ধুদের চা খাওয়ার মধ্যে দিয়ে আগামী সপ্তাহের টেন্ডারের কথাবার্তা চলছে হাঠৎ করে ইলিয়াসের ফোন আসে। ইলিয়াস একপাশে সরে যায় সুস্মিতার সাথে কথা বলার জন্য অন্যদিকে শামীমের কাছে বিরোধী দলের সজলের ফোন আসে।
সজল : শামীম তুমি তো জানো, আমার কাছে আগামী সপ্তাহে ১ কোটি টাকার টেন্ডার আসবে। আর এ নিয়ে ইলিয়াস আগের মতো বাড়াবাড়ি করবে।
শামীম : হুম!
সজল : তাই বলছিলাম- ইলিয়াসকে শেষ করে দাও!
শামীম : কেন?
সজল : তার বিনিময়ে তুমি ১ কোটি টাকার মধ্যে ৫০% পাবে। আমার কথার কোন বরখেলাফ হয় না।
শামীম : ইলিয়াসের সাথে আমি বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারবো না।
সজল : সুযোগ কিন্তু একবারই আসে শামীম। ইলিয়াস চলে গেলে তার অবস্থানে তুমি চলে যাবে। ভেবে দেখ?
শামীম : আমাকে কিছুদিন সময় দাও।
সজল : ঠিক আছে। আমি দু’দিন পর তোমার সাথে কথা বলব।
শামীম : ওকে।
শামীম অনেক ভাবার পর ইলিয়াসকে খুন করার জন্য বিরোধী দলের সজলের সাথে পরিকল্পনা করে। সজল বলে- আমরা ক্ষমতায় আছি; এইসব খুনের মামলা একটা বা-হাতের খেলা। সজল লোক ভাড়া করে এবং ইলিয়াস কোথায় আছে তা শামীম বলে দেয়। ইলিয়াস, শামীম, মারুফ ও জাহিদ বসে চা এর দোকানে চা খাচ্ছিল। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে সজলের এক লোক এসে হাঁটার মধ্য দিয়ে ইলিয়াসের বুকে ৩টি গুলি করে পালিয়ে যায়। ওই লোকটাকে ধরতে শামীম তাড়া করে। আর মারুফ ও জাহিদ এক চিৎকার করে ইলিয়াস ভাই বলে… বুকে জড়িয়ে ধরে। ভাই তোমারে আমারা মরতে দিমু না। আরো কত কিছু বলতে লাগল… ফিরে এসে শামীম বলে- ওই কুত্তার বাচ্চারে ধরতে পারি নাই।
তারপর ইলিয়াসকে বাঁচানোর জন্য আল-ফালাহ হাসপাতালে নিয়ে যায় দুর্ভাগ্য ক্রমে ইলিয়াস মৃত্যুবরণ করে। ঐ হাসপাতাল থেকে ডা. সুস্মিতার কাছে ফোন আসে।
ডা. সুস্মিতা : হ্যালো! স্যার বলেন-
ডা. ফয়সাল : একজন লোক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মারা গেছে। ওনার পোস্ট-মডেম রিপোর্ট করতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ডা. সুস্মিতা : ওকে! স্যার। আমি আসছি।
মর্গের ভিতরে ডা. সুস্মিতা লাশের কাছে গিয়ে বলে- ডোম লাশের মুখটা দেখাও। ডা. সুস্মিতা লাশের মুখ খানি দেখতেই আঁতকে ওঠে চিৎকার করে কান্না শুরু করে এবং পোস্ট-মডেম রুম থেকে বাহির হয়ে পরে। কান্নারত অবস্থায় ডা. ফয়সাল স্যারের রুমে গিয়ে বলে- স্যার আমি ঐ লাশের পোস্ট-মডেম রিপোর্ট করতে পারবো না!
ডা. ফয়সাল : কি হয়েছে তোমার?
ডা. সুস্মিতা : না স্যার! আমার দ্বারা সম্ভব না।
ডা. ফয়সাল : কেন? মৃত ব্যক্তি তোমার কে হয়?
সেদিন স্যারের কোন উত্তর না দিয়ে ডা. সুস্মিতা মাথা নাড়িয়ে স্যারের রুম হতে বাহির হয়ে; হাসপাতাল থেকে চলে যায়। এরপর সুস্মিতা কোথায় চলে যায় সেটা অজান্তেই রয়ে গেছে।

“মর্গের কোণে পড়ে থাকা লাশটাও একদিন জীবিত ছিল।
সেখান থেকে রূপ নিবে শূন্য একটা লাশে”

লেখক: সোলেমান ইসলাম তাওহীদ।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *