অর্থমন্ত্রীর এ উদ্যোগ কতটা যৌক্তিক?

অর্থনীতি ডেস্ক:: অর্থমন্ত্রী আবু মাল আবদুল মুহিত ৩১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীসহ অনেকের কাছে ‘তামাক ও সিগারেট উৎপাদন বন্ধকরণ’ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন।

চিঠির শুরুতে তিনি প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘২০৪১ সালের মধ্যে দেশে তামাক উৎপাদন এবং তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার আর থাকবে না’ প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করেছেন।

জনস্বাস্থ্য প্রশ্নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওই যুগান্তকারী ঘোষণা বাস্তবায়নের যে উদ্যোগের প্রস্তাব তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, সেখানে একধরনের চাতুরতার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। সিগারেট, বিড়ি, জর্দা- সবই তামাকজাত দ্রব্য এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

অথচ অর্থমন্ত্রী কেবল দেশীয় ক্ষুদ্র-কুটিরশিল্প বিড়ি ও জর্দার বিপরীতে বহুজাতিক কোম্পানির সিগারেট নির্মূলের ব্যাপারে তার অবস্থানের কথা জানাননি। গত বছরও অর্থমন্ত্রী একই কায়দায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী দুই বছর পর দেশে আর বিড়ি থাকবে না।

উল্লিখিত পত্রের বিষয় ‘তামাক ও সিগারেট উৎপাদন বন্ধকরণ’ হলেও তার প্রস্তাবিত উদ্যোগে তামাক চাষ ও সিগারেট উৎপাদন বন্ধের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ২২ বছর পর, ২০৪০ সালে।

পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিড়ি ও জর্দা বন্ধ করার পরিকল্পনা তিন বছরের মধ্যে। অর্থাৎ আগামী প্রায় ২০ বছর ধরে এ দেশে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো ব্যবসা করে যাবে।

অর্থমন্ত্রী তার চিঠিতে লিখেছেন, ‘বিড়িকে তিন বছরের মধ্যে নিষিদ্ধ করার একটি কঠোর সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে বিড়ি শিল্প নিয়েছে।’ এটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বিগত বছরে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর আগামী দুই বছর পর দেশে বিড়ি থাকবে না- এমন ঘোষণার পর থেকেই প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করে চলেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ।

মানববন্ধন, অবস্থান, মিটিং-মিছিলে শামিল হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বিড়ি শ্রমিক, বিড়ি ভোক্তা, বিড়ি শিল্পের মালিকসহ সমাজের বিভিন্ন সচেতন গোষ্ঠী ও ব্যক্তি। সেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন অর্থমন্ত্রীর সহকর্মী সংসদ সদস্যরাও।

রংপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য টিপু মুন্সী বলেছেন, ‘আমি যেখান থেকে নির্বাচিত হয়ে এসেছি, সেখানে প্রায় ৫০ হাজার বিড়ি শ্রমিক রয়েছে। এক দেড় মাস ধরে বিড়ি শ্রমিকদের চাপে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে মাননীয় স্পিকার। মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে বিড়ি বন্ধ করে দেবেন।’

শেরপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য একেএম ফজলুল হক সংসদে বলেছেন, ‘বৃহত্তর রংপুর, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও শেরপুরে বিড়ি শিল্প অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। এই বিড়ি শিল্প নিয়ে অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যেই এই শিল্প উঠিয়ে দেবেন।

তাদের (নারী বিড়ি শ্রমিক) একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে, তাদের অন্য একটা কিছু ব্যবস্থা না করে যেন এই বিড়িকে ধ্বংস করা না হয়।’

সত্য হচ্ছে, শুরু থেকেই সিগারেটের ওপর অর্থমন্ত্রীর পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন বছরের বাজেটে শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে বিড়ির প্রতি খক্ষহস্ত হয়ে এর বাজার দখলে সিগারেটকে উৎসাহিত করেছেন তুলনামূলক কম শুল্ক আরোপ করে।

সংসদ সদস্য ডা. হাবিব-এ মিল্লাত (সিরাজগঞ্জ-২) বলেছিলেন, ‘বিড়ির ওপর ট্যাক্স বাড়ালে সস্তা সিগারেটের ওপর ট্যাক্স বাড়ানোর কোনো বিকল্প নাই। সিগারেটের ওপর অবশ্যই ট্যাক্স বাড়াতে হবে।’

বরিশাল-৬ এর সংসদ সদস্য নাসরিন জাহান রত্না সংসদে বলেছিলেন, ‘বিড়ির রাজস্ব বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ১১০ শতাংশ কিন্তু সিগারেটে বৃদ্ধি করা হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ।’

কারও প্রতি অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত না নেয়ার জন্য মাননীয় মন্ত্রীরা শপথ নিয়েছেন। সিগারেট ও বিড়ি একই তামাকজাত পণ্য হওয়া সত্ত্বেও মাননীয় মন্ত্রীর উল্লিখিত উদ্যোগে বিড়ি বন্ধ করা হবে তিন বছরে আর সিগারেট পাবে ২২ বছর সময়।

কোন যুক্তিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিপরীতে বহুজাতিক কোম্পানিকে এমন একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ প্রদান? এই উদ্যোগের বাস্তবায়নে যে জনক্ষোভ দেখা দেবে, নির্বাচনের বছরে তার প্রভাব নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরা চিন্তা করে দেখবেন।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী তো নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন। তাই ভোট নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই।

সংবিধানের ১৮(১)-তে উল্লেখ রয়েছে, স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অথচ সরকার নিজেই তামাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে সরকারের রয়েছে ১০.৮৫ শতাংশ শেয়ার।

এর মধ্যে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) রয়েছে ৭.০৬ শতাংশ, সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ২.৮২ শতাংশ, রাষ্ট্রপতির নামে ০.৬৪ শতাংশ ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের নামে রয়েছে ০.৩৩ শতাংশ।

সরকারের শেয়ার থাকার কারণে বহুজাতিক এই সিগারেট কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে প্রভাবশালী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরই সুযোগে এই বহুজাতিক কোম্পানি সরকারের কাছ থেকে পেয়ে আসছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এবং এটি বিড়ির সঙ্গে বৈষম্য সৃষ্টিতে সহায়তা করছে।

অথচ বাংলাদেশের জন্মই বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ঐতিহাসিকভাবে এ কথা স্বীকৃত যে, পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাংলাদেশের জনগণের অবদান অপরিসীম। তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করলে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম শেষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সংবিধানের ১৯ (২)-তে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সেই চেতনা।

বলা হয়েছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য… অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

দেশীয় কুটির শিল্প বিড়িকে বৈষম্যের শিকার করে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলোকে আনুকূল্য প্রদান শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী নয়, লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে প্রতারণা করা এবং সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।

বিড়ি নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী সঠিক বক্তব্য দেননি। চিঠিতে তিনি লিখেছেন- ‘বিড়িকে তিন বছরের মধ্যে নিষিদ্ধ করার একটি কঠোর সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে বিড়ি শিল্প নিয়েছে।’ অথচ বিড়ি শিল্প এমন কোনো সিদ্ধান্তই নেয়নি।

কে নিজের কবর খনন করে? বরং অর্থমন্ত্রীই একাধিকবার মহান সংসদসহ বিভিন্ন জায়গায় বিড়ি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ এ দায়ভার তিনি এখন বিড়ি শিল্পের ওপর চাপাতে চাচ্ছেন।

তিন বছরের মধ্যে নিষিদ্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত বিড়ি শিল্প নেয়নি, বরং গত বছর অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তামাক চাষী, বিড়ি শ্রমিক, বিড়ি ব্যবসায়ী, বিড়ি ভোক্তাসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ।

সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, মিটিং-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে।

সিগারেটের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। গত বছর তিনি বলেছিলেন, ‘সিগারেট তুলে দিতে পারব না। এটা বিশ্বের সব দেশেই আছে।’

উল্লিখিত চিঠিতেও তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার থেকে প্রচুর পরিমাণে বিড়ি আমদানি হয় অবৈধ পথে। সুতরাং এ কারণে কার্যক্রমটি প্রতিবেশী দুটি দেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে।’

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বিড়ি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশে উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হয়।

সুতরাং বিশ্বের অন্যান্য দেশে থাকার কারণে সিগারেট তুলে দিতে না পারলে একই কথা বিড়ির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একইভাবে দেশে বিড়ি নিষিদ্ধ হলে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বিড়ি আসা অর্থমন্ত্রী বন্ধ করবেন কী করে?

প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, ভারতে বিড়িকে কুটির শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সরকার এই শিল্প রক্ষার জন্য নানা ধরনের কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের টেন্ডুপাতা আর কুচবিহার গুজরাটের তামাকপাতা দিয়ে বিড়ি তৈরি হয়।

বর্তমানে ছোট বড় দু’শ বিড়ি কারখানায় প্রায় ২০ লাখ বিড়ি শ্রমিক কাজ করছে। কেবল মুর্শিদাবাদ জেলায় বিড়ি শ্রমিক রয়েছে ১২ লাখ। এই জেলার ‘পতাকা বিড়ি’ ভারতের সবচেয়ে বড় বিড়ি কারখানা।

এই কারখানায় প্রতিদিন ১৩ কোটি টাকার বিড়ি উৎপাদন হয়। এখানকার বিড়ি আমেরিকাসহ পৃথিবীর ১২২টি দেশে (প্রতিবছর এক হাজার টন) রফতানি হয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বিড়ি শ্রমিকদের কল্যাণে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করেছে।

প্রতিবছর দুই দফায় সরকার দশ হাজার টাকা করে বিড়ি শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান দেয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ২ হাজার ৫শ’ টাকা ও গৃহনির্মাণ অনুদান হিসেবে ৪০ হাজার টাকা দেয়া হয়।

ভারতে বিড়ির ওপর শুল্কও অনেক কম। বাংলাদেশে যেখানে প্রতি হাজার বিড়িতে শুল্ক ২৪৭.৫০ টাকা, সেখানে ভারতে তা মাত্র ১৪ টাকা। সুতরাং অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবমতো তিন বছরে বিড়ি নিষিদ্ধ হলে ভারতের বিড়ির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যাবে কীভাবে?

ওই চিঠিতে অর্থমন্ত্রী ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির সরকারি শেয়ার নির্দিষ্ট একটি মেয়াদে তুলে নেয়ার প্রস্তাব করেছেন।

সংবিধান লঙ্ঘন করে সরকারের তামাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে তিনি প্রস্তাব করেছেন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার, অথচ বিড়ি নিষিদ্ধ করতে চান ২-৩ বছরের মধ্যে। এটা কতটা যৌক্তিক?

মুহাম্মদ আবদুস সবুর : খণ্ডকালীন শিক্ষক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *