নগরজুড়ে শিলং তিরের প্রকাশ্যে চলছে শতাধিক স্পট

নিজস্ব প্রতিবদেক:: পাকা টিনশেড ঘর। দুটি চেয়ারে বসে আছেন দুজন যুবক। সামনের টেবিলে আছে কাগজের কিছু টুকরো। গ্রাহকরা আসছেন সারি বেঁধে। চেয়ারে বসা যুবকরা তাদেরকে ১০ টাকার বিনিময়ে একটি টোকেন দিচ্ছেন। কেউবা নিচ্ছেন কয়েকটি। এমনকি কেউ কেউ একসাথে ৫০টি টোকেনও নিচ্ছেন। এ যেন কোনো যানবাহনের অথবা চিকিৎসকের টিকিট কাউন্টার। কিন্তু আসলে এই টোকেন হচ্ছে শিলং তির খেলার। এমন দৃশ্য নগরীর শতাধিক স্থানে এমনি খোলামেলাভাবে চলছে শিলং তিরের জমজমাট মচ্ছব।নগরীতে খোলাখুলিভাবে এমন শিলং তির খেলার কথা পুলিশ জানে না, তা নয়। পুলিশের কতিপয় নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কনস্টেবলকে ম্যানেজ করেই শিলং তির খেলা চলছে। অথচ তির খেলার মাধ্যমে জুয়ার আসরের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করেছিল মহানগর পুলিশ। এর অংশ হিসেবে গোয়েন্দা পুলিশের ব্লকরেইডও চলেছে।

পুলিশ সূত্রমতে, গত কয়েক মাসে সিলেটে অন্তত শতাধিক জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয়। আর এই অভিযানে সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু জুয়ার আসর বন্ধ করা হলেও ফাঁড়ি ও আবার কোনো না কোনো কারণে তির খেলা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সিলেটের আনাচে-কানাচে।শিলং তির খেলা শুধু সীমান্তবর্তী এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়, ওইসব এলাকা ছাড়িয়ে এখন ছড়িয়ে পড়েছে নগরীর অলিগলিতে। এমনকি এ খেলা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায়ও। সিলেটের যে-কোনো এলাকায় বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিলং জুয়ায় বাজি ধরেন জুয়াড়িরা। এ খেলাটি সপ্তাহের ছয়দিনই বসে। প্রতিদিন দু বার এ খেলার ড্র অনুষ্ঠিত হয়। ভাগ্যের জন্য দু-একজন পেলেও বাকিরা খালি হাতে ফিরেন জুয়ার বোর্ড থেকে। ০ থেকে ৯৯ জন এ খেলার নাম্বার নিলেও প্রতিদিন কেবল একজনই দেখা পান কথিত ভাগ্যের চাকার। সেদিন তিনিই তিরের বোর্ডের বাদশা। অন্যরা সেদিনের জন্য জিরো। মাঝে মধ্যে এমন হিরোদের দেখা পেলেও জিরোদের সংখ্যাটাই বেশি। কারণ প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শিলং থেকে প্রকাশিত ওয়েবসাইটে এ খেলার দুটি ফল প্রকাশ করা হয়। যেখানে প্রতি ২শ’ জনের মধ্যে ভাগ্যের দেখা পান মাত্র একজন। অন্যদের ফিরতে হয় শূন্য হাতে। তবুও তারা হার মানতে রাজি নন! রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পথের ফকির হতে চলেছেন। এ খেলার বিস্তার সিলেটে দিন দিন বেড়ে চললেও প্রশাসন ‘শিলং তির’ চক্রকে ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। খোলাখুলিভাবে তারা টিকিট বিকিকিনি করছে।এ যেন মারাত্মক এক নেশা। এমন নেশায় পড়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় নেমেছেন। দিন শুরুর পর থেকেই নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের কাছ থেকে শুরু হয় নাম্বার কেনা। কেউ কিনেন সরাসরি। কেউবা ‘বিকাশ’ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এ খেলায় অংশ নেন। টাকা হাতে চলে গেলে দিয়ে দেওয়া হয় কাক্সিক্ষত নাম্বার। সিলেটে তাদের এজেন্টের মাধ্যমে এ দেশীয় এজেন্টরা ভারতের এজেন্টদের সাথে জুয়ার আসরের সমন্বয় করে থাকেন। আর ভাগ্যের খেলায় স্কুল-কলেজের ছাত্র, দিনমজুর, রিকশাচালক, যানবাহনের চালক-শ্রমিকসহ বেকার যুবকরা অংশ নিচ্ছেন। আর এতে অনেক স্কুলগামী ছাত্ররা স্কুল ফাঁকি দিয়ে এ খেলায় অংশ নিচ্ছে। এতে ছাত্রদের মনোযোগ বইয়ের পরিবর্তে জুয়ার প্রতি বাড়ছে। ইদানীং মহিলারাও এই খেলায় অংশ নিতে শুরু করেছেন। ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’র আশায় শিলং তিরের প্রতি মহিলারাও আকৃষ্ট হচ্ছেন। মহিলারাও ঘরে বসে এ খেলায় অংশ নেন। এ যেন ‘যদি লাইগা যায়’।

পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করেও দমন করা যাচ্ছে না ‘শিলং তির’। গ্রেপ্তারের পর জামিনে বের হয়ে পুনরায় ওই খেলায় জড়িয়ে পড়ছেন জুয়াড়িরা। ২০ থেকে ২৫ বছর পূর্বে ভারতীয় ধনকুবেররা এ খেলাটি আবিষ্কার করে। এর নাম রাখেন মেঘালয়ের আঞ্চলিক ভাষায় ‘তির খেলা’। পরে ধীরে ধীরে স্থানীয়ভাবে খেলাটিকে অনেকেই শিলং তির, ডিজিটাল নাম্বার খেলা ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকেন।জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধির পছন্দ না হলে অথবা জনপ্রতিনিধিদের কর্মীরা সন্তুষ্ট না হলে ভারতীয় তির খেলার স্পট (এজেন্ট) নেওয়া যায় না। অপর দিকে এসব এলাকার মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই এই তির খেলার নেপথ্য নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করছেন।গত বৃহস্পতিবার দিনভর নগরীর বিভিন্ন ‘শিলং তির’ স্পট ঘুরে পাওয়া গেল বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিকেল থেকে শুরু হওয়া খেলার নিয়ম হচ্ছে ১ টাকায় ৭০ গুণ অর্থাৎ ৭০ টাকা। সারাদিনে এ খেলার ২টি বাজি টানা হয় একটা বিকেল ৫ টায় অপরটি সন্ধ্যা ৭ টায়। ভারতের শিলং হচ্ছে এ খেলার মূল স্থল, সেখানে লটারি টানা হলে একই নম্বরে বাংলাদেশেও লটারি ফলাফল দেওয়া হয়। সিলেটে জুয়ার পুরাতন আস্তানাগুলোকে কেন্দ্র করে তির খেলা পাড়ায়-পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এই সব তিরের এজেন্টদের শেল্টার দিচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের কিছু সংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা-কনস্টেবল, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও তাদের গ্রুপের কর্মী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। বিভিন্ন এলাকায় তির শিলং খেলায় পুলিশের কিছু সদস্য সহযোগিতা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। নিয়মিতভাবে তারা এসব জুয়ার আসর থেকে বড় অংকের টাকাও নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

প্রথমে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকা ভোলাগঞ্জ, দয়ারবাজার, বিছনাকান্দি, পাড়–য়া, জাফলং, মামার দোকান, তামাবিল, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় এসব অবৈধ তির খেলার প্রচলন ছিল। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে নগরীর বিভিন্ন রাস্তাঘাট, সরকারি অফিসের পেছন, বিভিন্ন কলোনি, রেস্টুরেন্ট, চা-দোকানসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান অবস্থায় এই খেলার নম্বর টোকেন বিক্রি হয়। ১০ টাকায় ৭০০ টাকা পাওয়া যায়, এমন খেলায় আগ্রহী হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপের কর্মী, রিকশা-ভ্যানচালক, অটোরিকশাচালক, শ্রমিক, দিনমজুর এমনকি প্রশাসনের কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল ও কলেজের শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ বেকার যুবকরা এই ‘তির খেলায়’ অংশ নিচ্ছেন। ।

বিভিন্ন থানার অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় চলছে এ খেলা। কাজিরবাজারস্থ কাঠালহাটা এজেন্টের একজন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে কাঠালহাটা বোর্ডের মালিক তারা দু জন। ডিউটিতে থাকা পুলিশকে প্রতিদিন তারা ২০০-৩০০ টাকা করে দেন। প্রত্যেকদিন ভিন্ন ভিন্ন পুলিশের লোক এসে এই টাকা নিয়ে যান। লালদিঘিরপার ও কালীঘাটের তিরের বোর্ডের এজেন্টের আরেক জন জানান, অনেকদিন যাবৎ তারা এ বোর্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন সময় প্রশাসনের বিভিন্ন লোক লালদিঘিরপার ও কালীঘাটের তিরের বোর্ড থেকে টাকা নিয়ে আসেন। ফকির মিয়ার কলোনির শিলং তিরের এজেন্ট বলেন, দীর্ঘদিন থেকে এই কলোনিতে বোর্ড পরিচালনা করে আসছেন। নির্ভয়ে এবং নির্দ্বিধায় তারা বোর্ড পরিচালনা করছেন। এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মো. আব্দুল রউফ জানান, তির শিলং খেলার বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর। তির শিলংয়ে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে। যারা এই জুয়াখেলে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে খেলে। তিনি বলেন, তির খেলা নির্মূল করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষ সচেতন হলেই এই খেলা বন্ধ হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিটিআরসিতে দু বার চিঠি দেওয়া হয়েছে, এখন পর্যন্ত কোনো রেজাল্ট আসেনি। এই খেলা বন্ধের প্রধান উৎস হল, ওই সার্ভার (উৎস) বন্ধ করতে হবে। তাহলে এই তির শিলংয়ের জুয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *