ফসল রক্ষা বাঁধের টাকায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তদন্তে নেমেছে গোয়েন্দারা

নিজস্ব প্রতিনিধি :: সুনামগঞ্জের প্রায় অর্ধশত হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধে এবার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ছিল দৃশ্যমান। প্রতিটি উপজেলায়ই হাওররক্ষা বাঁধের কথা বলে একাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের অর্থ অপচয় ও ভিন্নখাতে ব্যবহার করা হয়েছে।

কৃষক ও সচেতন লোকদের অভিযোগ নতুন নীতিমালায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সর্বেসর্বা করায় তারা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের পরামর্শে অজান্তেই অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প অনুমোদন ও বরাদ্দ দিয়েছেন। এই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম দিকেই মন্ত্রণালয়ে অবগত করায় মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রায় শতাধিক প্রকল্প বাতিল করা হয়েছিল। এরপরও আরো শতাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পত্র-পত্রিকা ও কৃষকসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বিষয়ে অভিযোগ আসায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের বিভিন্ন শাখা এ বিষয়ে তদন্ত চালাচ্ছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

তাছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন এসব বিষয়ে শীঘ্রই মামলা করবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত বছর হাওরের সম্পূর্ণ ফসল আগাম তলিয়ে যাওয়ায় সরকার ২০১৭-২০১৮ সালে কাবিটা নীতিমালা পরিবর্তন করে। এই নীতিমালায় জেলা প্রশাসককে বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির প্রধান এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের উপজেলা পর্যায়ে প্রধান করে নির্দেশনা জারি করে। গত অক্টোবর মাসে তড়িঘড়ি করে মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে কাটছাঁট করে প্রকল্পগুলো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। এসময় অপ্রয়োজনীয় শতাধিক প্রকল্প বাতিল করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা রুটিন কাজে ব্যস্ত থাকায় তাদের পক্ষে নিয়মিত হাওরে গিয়ে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করা সম্ভব হয়নি। তাই তারা বাধ্য হয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের এই কাজে যুক্ত করেন। এই সুযোগে বেশ কিছু চতুর চেয়ারম্যান হাওররক্ষা বাঁধের সঙ্গে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে গ্রামীণ রাস্তাঘাটও হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের নাম ধরে অনুমোদন করিয়ে মোটা অংকের বরাদ্দ হাতিয়ে নেন। নিজেরা পিআইসিতে না থাকলেও নিজেদের পছন্দের লোক ও আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে নামকাওয়াস্তে কমিটি গঠন করে কাজের তদারকি, নেপথ্যে থেকে বিল উত্তোলনসহ সব কাজ করেন তারা। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু উপসহকারি কর্মকর্তাদের দিয়েও অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রাক্কলন সম্পন্ন করিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের মাধ্যমে অনুমোদনও করিয়ে নেন।

জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাটছাঁট করে প্রায় ৯৬৪টি চূড়ান্ত প্রকল্পে হাওররক্ষা বাঁধের কাজ বাস্তবায়ন চলছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রায় শতাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এখনো রয়েছে। বাস্তবায়নকারীরাও ঘুরে এই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের দেখা পেয়েছেন। কিন্তু দ্রুত কাজ আদায়ের স্বার্থে তারা এ নিয়ে ব্যবস্থা না নিলেও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের তালিকা করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে একাধিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের কারণদর্শানো নোটিশ দিয়েছে। ১১ উপজেলার দুর্গম হাওর বাদেও সদর উপজেলাগুলোতেও এই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের হিড়িক লক্ষ্য করা গেছে। সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী, মোল্লাপাড়া, কোরবাননগর, মোহনপুর, কাঠইর, গৌরারং ইউনিয়নে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। এ নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক অভিযোগও করেছেন। জানা গেছে, এসব অভিযোগ, কাজ সম্পন্ন না হওয়াসহ নানা কারণে তৃতীয় ও চতুর্থ বিল আটকে দেওয়া হয়েছে। ফসল ওঠার আগে আর এই বিল দেওয়া হবেনা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন দফতর অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ নানা বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছে। ছোট বিলেও হাওররক্ষার কথা বলে কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এমন নজিরও আছে। ধর্মপাশা উপজেলার মাত্র লাখ টাকার ধান রক্ষায় প্রায় ৭২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের ডাকুয়ার হাওরের প্রায় ৫০ লাখ টাকার ফসল রক্ষায় প্রায় ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ওই হাওরটি রক্ষার জন্য মূল স্থানে নদীর পাড়ে বাঁধ না দিয়ে অন্য এলাকায় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ নিয়ে গত সপ্তাহে এলাকাবাসী মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনসহ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদন করেছেন। এভাবে প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নেই অপ্রয়োজনীয় একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

জানা গেছে, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মাঠ পর্যায়ের কৃষক, কৃষকের প্রতি সংহতি জানানো স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এবং বাঁধের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ নানা বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা পরিদর্শন শেষে যা দেখেছেন তা বর্ণনা করেছেন এসব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে।

মোহনপুর ইউনিয়নের দেওয়াননগর গ্রামের মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাদের হাওরটি খুবই ছোট। কিন্তু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। তাছাড়া যেখানে প্রকল্প গ্রহণের কথা সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে চেয়ারম্যান তার পছন্দ মতো নির্বাচনী প্রকল্প গ্রহণ করে চলছেন।

হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, আমরা প্রায় সারা জেলার বিভিন্ন বাঁধ পরিদর্শন করেছি। প্রতিটি উপজেলায়ই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে হাওররক্ষা বাঁধের টাকা অন্যখাতে খরচ করা হচ্ছে। আমরা যতদূর জানি এ নিয়ে প্রশাসনের মধ্যেও অসন্তোষ চলছে। কিন্তু কাজের স্বার্থে তারা এ নিয়ে কথা বলছেন না। তবে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে তথ্য নিয়েছেন। আমরা মাঠ ঘুরে আসা প্রকৃত তথ্য তাদের দিয়েছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া বলেন, আমার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বিষয়ে নানা অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে আমরা প্রকল্পগ্রহণকারীদের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছি। তাছাড়া এই অবস্থা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবগত করেছি। গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন দফতর এটা করতে পারে।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *