বৃহস্পতিবার স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশটির সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী আইনে পরিণত হয়েছে। যার মাধ্যমে পাকিস্তানের শীর্ষ আদালতগুলোর পরিচালনা পদ্ধতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে।
যারা এই পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলছেন তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশাসনিক কাঠামো প্রদান করবে, একই সাথে আদালতে মামলার জট কমাতেও সাহায্য করবে।
পারমাণবিক অস্ত্রধারী এই দেশটির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সেনাবাহিনী। কখনও কখনও তারা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে, আবার অনেক সময় পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নেড়েছে।
পাকিস্তানের ইতিহাসে, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এবং জেনারেল জিয়া-উল-হকের মতো সামরিক নেতাদের প্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণের ফলে দেশটি একাধিকবার দোদুল্যমান পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।
বেসামরিক এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার এই ভারসাম্যকে হাইব্রিড শাসন হিসাবে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। সংবিধানের নতুন সংশোধনীকে এখন সেই ভারসাম্য পরিবর্তন হয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষে ঝুঁকে পড়া হিসেবে দেখছেন অনেকে।
সংবিধানের এই সর্বশেষ সংশোধনীর ফলে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মুনির এখন পাকিস্তানের নৌ ও বিমান বাহিনীরও তত্ত্বাবধান করবেন। তার ফিল্ড মার্শাল পদবি ও পোশাক আজীবনের জন্য এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অবসর গ্রহণের পরেও তাকে ‘দায়িত্ব এবং কাজ’ প্রদান করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে যে, এই সিদ্ধান্তের কারণে, তিনি আজীবন জনপরিসরে কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন। বিলটির সমর্থকরা যুক্তি দিয়েছেন যে, এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের সামরিক কমান্ড কাঠামোকে আরও স্পষ্ট করে।
পাকিস্তানের সরকার-পরিচালিত সংবাদ সংস্থা, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অফ পাকিস্তান, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফকে উদ্ধৃত করে বলেছে যে, এই পরিবর্তনের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। যা দেশটির একটি বৃহত্তর সংস্কার এজেন্ডার অংশ। কিন্তু অন্যরা এটিকে সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হিসেবে দেখছেন।
‘কাজ পরিচালনার জন্য স্বাধীন স্থান’ নেই
এই পরিবর্তনের আরেকটি বিতর্কিত ক্ষেত্র হল আদালত এবং বিচার বিভাগ।
সংশোধনীর অধীনে একটি নতুন ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত বা এফসিসি তৈরি করা হবে যা সাংবিধানিক প্রশ্নগুলোতে সিদ্ধান্ত নেবে। এই আদালতের প্রথম প্রধান বিচারপতি এবং এতে কর্মরত বিচারকদের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করবেন।
‘এটি ন্যায্য বিচারের অধিকারের আকার এবং প্রকৃতি চিরতরে বদলে গেলো’ – মিসেস জাহাঙ্গীর বলেন। তিনি বলছেন, ‘শুধু বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, সাংবিধানিক বেঞ্চগুলোতেও নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন রাষ্ট্র সেই বেঞ্চগুলোর গঠন নির্ধারণ করছে, তখন একজন মামলাকারী হিসেবে আমার ন্যায্য বিচার পাওয়ার কী আশা আছে?’
সাংবাদিক ও ভাষ্যকার আরিফা নূর বলছেন, ‘বিচার বিভাগ এখন নির্বাহী বিভাগের বেশ অধীনস্থ। সাধারণভাবেই মনে হচ্ছে যে বিচার বিভাগের এখন আপাতত কাজ করার জন্য কোনও স্বাধীন স্থান থাকবে না।’
যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে যে, দুটিকে আলাদা করার ফলে আদালতের কাজের প্রক্রিয়া মসৃণ হয়েছে।
কিছু আইনজীবীর কাছে এই সিদ্ধান্ত কিছুটা আকর্ষণীয় হলেও সুপ্রিম কোর্টের করাচি-ভিত্তিক আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ এই বক্তব্যকে অযৌক্তিক বলে মনে করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানে বিচারাধীন বেশিরভাগ মামলা কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে নেই।
তার মতে, ‘পরিসংখ্যানগতভাবে, যদি আপনি সত্যিই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে চিন্তিত হতেন, তাহলে আপনি সেই মামলাগুলোর বিষয়ে সংস্কারের ওপর মনোযোগ দিতেন।’
সংশোধনীটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই, সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেন।
‘যে সংবিধানকে সমুন্নত রাখার এবং রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম, তা আর নেই’ – বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ তার পদত্যাগপত্রে বলেছেন।
বিচারপতি মনসুর আলী শাহ বলছেন, বিচার বিভাগকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং ২৭তম সংশোধনী ‘সুপ্রিম কোর্টকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে’।
বিচারকদের এখন তাদের সম্মতি ছাড়াই বিভিন্ন আদালতে বদলি করা যেতে পারে। যদি তারা বদলিতে রাজি না হন, তাহলে বিচার বিভাগীয় কমিশনে আপিল করতে পারবেন বিচারকরা। তবে, বদলি না করার কারণ অবৈধ বলে প্রমাণিত হলে, ওই বিচারককে অবসর গ্রহণ করতে হবে।
যারা এই সিদ্ধান্তের পক্ষে আছেন তাদের যুক্তি, এর ফলে দেশের সকল এলাকার আদালতে কর্মী নিয়োগ নিশ্চিত হবে। তবে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে এটি হুমকি হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে।
‘যে প্রদেশে কর্মরত আছেন সেখান থেকে একজন বিচারককে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত, সরকারের কথা মেনে নিতে ওই বিচারকের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে’ – আহমেদ বলেন। তিনি উদ্বিগ্ন যে এই পরিবর্তন পাকিস্তানের ভারসাম্য নষ্ট করবে।
‘আমাদের বিচার বিভাগ অতীতে স্বৈরশাসকদের সাথে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু তারা নির্বাহী বিভাগকে কখনও কখনও ধাক্কা দিয়েছে। আমার মনে হয় যদি আপনি মানুষের কাছ থেকে সেই আশাও সম্পূর্ণরূপে কেড়ে নেন, তাহলে সেটি তাদেরকে অন্য, আরও কুৎসিত দিকে ঠেলে দেবে।’
মি. কুগেলম্যান একমত যে, ‘অবরুদ্ধ পরিস্থিতি সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও ভালো লক্ষণ নয়।’
‘এটি কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত দেয়’ বলে মনে করেন আরিফা নূর।
তিনি বলছেন, সর্বশেষ সংশোধনী গত বছর করা ২৬তম সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে আইন প্রণেতাদের পাকিস্তানের শীর্ষ বিচারক নির্বাচনের ক্ষমতা দিয়েছিল। ইতোমধ্যেই ২৮তম সংশোধনীর জল্পনাও চলছে।


