মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি: বাংলাদেশে নির্বাচনের মৌলিক প্রতিশ্রুতি— স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও জনগণের আস্থা। কিন্তু মুন্সীগঞ্জে সেই আস্থা আজ বড় প্রশ্নের মুখে। জেলার নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন–এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের স্বার্থ রক্ষায় একতরফাভাবে ভোটকেন্দ্র স্থানান্তর করছেন।
একটি সিদ্ধান্ত— যা কেবল একটি কেন্দ্র নয়, বরং পুরো জেলার নির্বাচনী নিরপেক্ষতা নিয়ে গভীর সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর ইউনিয়নের ৪৬নং কালিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়— এটি শুধু একটি ভোটকেন্দ্র নয়, বরং স্থানীয় গণতন্ত্রের প্রতীক।
১৯৩৮ সাল থেকে কেন্দ্রটি শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, “এই স্কুলে কখনও গোলমাল হয়নি, সবাই মিলে শান্তিতে ভোট দিয়েছি।”তবুও, হঠাৎ করে সেই কেন্দ্র স্থানান্তরের প্রস্তাব আসায় এলাকাবাসীর মনে জন্ম দিয়েছে সন্দেহ ও ক্ষোভ।
অভিযোগ উঠেছে, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কেন্দ্রটি সরিয়ে নিতে চান সিরাজদিখান উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবুবকর ছিদ্দিকের নিয়ন্ত্রিত ও নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ‘হাজী আবু বকর সিদ্দিক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে’।
এলাকার মানুষ বলছেন—“একজন দলীয় নেতার স্কুলে ভোট হলে সেখানে নিরপেক্ষতা থাকবে কীভাবে? ভয়ে মানুষ ভোট দিতেই আসবে না।”
বিষয়টি কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এক রাজনৈতিকভাবে আওয়ামীলীগকে পুনর্বাসন করার প্রচেষ্টা বলেও মনে করছেন অনেকে।
ঘটনার সূত্র ধরে ৬ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে, বেলা ১১.৩০ মিনিটে জেলা নির্বাচন অফিসে শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু অভিযোগের বাদী মহিউদ্দিন উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নিজেই বাদীর পক্ষ হয়ে বক্তব্য দেন এবং একতরফাভাবে শুনানি পরিচালনা করেন।
শুনানিতে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানান—“তিনি আমাদের কথা বলতে দেননি। বারবার আওয়ামী লীগপন্থী বক্তব্য দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে আমরা শুনানি ছেড়ে বের হয়ে আসি।”এমন আচরণ শুধু প্রশাসনিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী নয়— এটি নির্বাচনী আইনেরও লঙ্ঘন, যেখানে জনমতের ভিত্তি নিশ্চিত করাই মূল নীতি।
নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ভোটকেন্দ্র পরিবর্তনের আগে স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ ও নিরাপত্তা মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে কোনো জনমত গ্রহণ বা বিকল্প বিশ্লেষণ করা হয়নি বলে অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন।
তারা বলেন“আমাদের সঙ্গে কেউ পরামর্শ করেনি। আমরা কেবল খবর পেয়েছি— আমাদের স্কুল থেকে ভোটকেন্দ্র অন্যত্র যাচ্ছে!”
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয়— কেন্দ্র বদল মানে বয়স্ক ও নারী ভোটারদের দূরে সরিয়ে দেওয়া।
কালিনগরের বৃদ্ধ মোঃ জজ মিয়া মুন্সি বলেন—“আমার বয়স ৭৫। প্রতি নির্বাচনে এই স্কুলেই ভোট দিয়েছি। এখন প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে যেতে হবে, কীভাবে যাব?”
এই আশঙ্কাই স্থানীয়দের মনে প্রশ্ন তুলেছে— “এটা কি নির্বাচনী সুবিধা অর্জনের কৌশল নয়?”
অভিযোগকারীরা ইতোমধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
তাদের দাবি—“নির্বাচন কর্মকর্তার পক্ষপাতমূলক ভূমিকা গণতন্ত্রকে বিপন্ন করছে। তাই তাকে অবিলম্বে বদলি করে তদন্ত করা হোক।”
তারা আরও বলেন— “একজন সরকারি কর্মকর্তার হাতেই যদি দলীয় রাজনীতি চলে আসে, তাহলে সাধারণ মানুষ ভোটের অধিকার হারাবে।”একজন কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত যদি জনগণের সন্দেহ তৈরি করে, তাহলে পুরো প্রক্রিয়া অচল হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের একতরফা সিদ্ধান্ত ভোটার উপস্থিতি হ্রাস, সামাজিক বিভাজন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
মুন্সীগঞ্জের এই ঘটনাটি কেবল একটি কেন্দ্র বা কর্মকর্তার গল্প নয়— এটি পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরীক্ষা।
একজন প্রবীণ নাগরিকের কথায়—“আমরা শুধু ভোট চাই না, চাই সম্মানিত নাগরিক হিসেবে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে। কিন্তু যদি নির্বাচন কর্মকর্তাই পক্ষ নেন, তাহলে আমাদের ভোট গণনা হবে না— গোনা হবে কেবল তাদের সুবিধা।”
এলাকাবাসীর স্পষ্ট দাবি— জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনকে অবিলম্বে বদলি করে আইন অনুযায়ী তদন্ত করা হোক, যাতে আসন্ন নির্বাচনে জনগণ আবার আস্থা ফিরে পায়।
৮নং ওয়ার্ডের ভোটার আব্দুল্লাহ আল জাদিদ ইরান বলেন নির্বাচন কমিশনারের কর্মকর্তারা একতফা কাজ করে যাচ্ছেন। যে জায়গায় কেন্দ্র স্থাপন করার চেষ্টা করছেন সেই স্থানটি হচ্ছে সিরাজদিখান উপজেলা আওয়ামিলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুবকরের স্থান। তার দিকনির্দেশনায় স্বজনপ্রীতি করে এলাকায় ঝগড়া তৈরি করার জন্য এ কাজ করছেন। আওয়ামীলীগের দোসরদের পক্ষে কাজ না করার অনুরোধ জানান তিনি।
এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ জসিমউদ্দিন জানান, খসড়া তালিকা সংক্রান্ত প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে। যাতে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কাজ চলছে।