গণস্বাক্ষরসহ শ্রম উপদেষ্টা বরাবর হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের স্মারকলিপি প্রদান

অবিলম্বে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে হোটেল সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে মজুরি নির্ধারণ, নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক, সাপ্তাহিক ছুটি প্রদানসহ শ্রম আইন বাস্তবায়ন, শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী সকল কালো আইন বাতিল ও গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন এবং স্বল্পমূল্যে সর্বাত্মক রেশনিং চালুর দাবিতে ১৩ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩০ মিনিটের সময় জালালাবাদ পার্কের সামনে জমায়েত হয়ে সিলেট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর শ্রমিকদের গণস্বাক্ষরসহ স্মারকলিপি প্রদান করে সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নং চট্ট-১৯৩৩)।
স্মারকলিপি প্রদানের পূর্বে জালালাবাদ পার্কে সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা সভাপতি মো. ছাদেক মিয়া এবং  সভা পরিচালনা করেন সহ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সরকার, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদক রমজান আলী পটু  সিলেট জেলা স’মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন, সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের অন্যতম নেতা আনোয়ার হোসেন, দক্ষিণ সুরমা উপজেলা কমিটির সহ-সম্পাদক আব্দুল মুমিন রাজু, আম্বরখানা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি রাশেদ আহমেদ ভূঁইয়া, বন্দরবাজার আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মোঃ শাহাবুদ্দিন, জিন্দাবাজার আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক  হাবিবুর রহমান সেহান, জালালাবাদ থানা কমিটির প্রচার সম্পাদক আব্দুর রহিম।
স্মারলিপিতে নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট-মিষ্টি-বেকারী সেক্টর বাংলাদেশে অন্যতম একটি শ্রম সেক্টর। অথচ এ সেক্টরে বাংলাদেশ শ্রম আইন প্রতিপালিত হচ্ছে না। সিলেট জেলায় দীর্ঘদিন ধরে সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে হোটেল ও রেস্টুরেন্ট সেক্টরে শ্রম আইন কার্যকর করার দাবি জানালেও মালিকরা তা বাস্তবায়ন করছে না। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর ৫-ধারায় নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র, ৬-ধারায় সার্ভিস বই, ২৬-ধারায় চাকুরীচ্যূতি জনিত ৪ মাসের নোটিশ পে, ১০৩-ধারায় সপ্তাহে দেড়দিন সাপ্তাহিক ছুটি, ১০৮-ধারায় দৈনিক ৮ ঘন্টা সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টা কাজ এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য দ্বিগুণ মজুরি প্রদান, ১১৫-ধারায় বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি, ১১৬-ধারায় ১৪ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটি, ১১৭-ধারায় প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন অর্জিত ছুটি, ১১৮-ধারায় ১১ দিন উৎসব ছুটি প্রদানের আইন থাকলেও হোটেল শ্রমিকদেরকে এই সকল আইনগত অধিকার হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ সকল আইনী অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়নের জন্য হোটেল-রেঁস্তোরা মালিক সমিতি, সরকারের শ্রম দপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ইউনিয়নের পক্ষ হতে একাধিবার চিঠি ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের দাবির প্রেক্ষিতে বিগত সময়ের কোন সরকারই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। শ্রমিকদের কাছে প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র না থাকায় প্রায়সময়ই রাস্তাঘাটে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে শ্রমিকরা নিজেদের কর্ম পরিচয় নিশ্চিত করতে না পারায় অনেককে মিথ্যা-মামলা ও জেলহাজত পর্যন্ত খাটতে হয়।
আরও উল্লেখ করেন, গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। প্রায় সহস্রাধিক ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-জনগণের লাশের বিনিময়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে সেই সরকারের কাছে সঙ্গতকারণেই শ্রমিকদের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। আওয়ামীলীগ সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় অন্যান্য মজুরি বোর্ডগুলির মত হোটেল সেক্টরের মজুরি বোর্ডও গঠন করা হয়। অথচ বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে যাকে মনোনীত করা হয়েছে তিনি হোটেল সেক্টরের শ্রমিকদের সমস্যা তুলে ধরতে যেমন কোনভাবেই যোগ্য নয়, একই সাথে মালিকদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে যোগ্যতম প্রতিনিধি নিয়ে মজুরিবোর্ড পুনর্গঠন করার জন্য অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই হোটেল সেক্টরের একমাত্র সক্রিয় ফেডারেশন বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় বরাবর পত্র প্রেরণ করে। তথাপি দলীয় বিবেচনায় গঠিত পূর্বের বোর্ড অব্যাহত রেখে মজুরিবোর্ড কার্যক্রম অগ্রসর করছে। আমরা বর্তমান বাজারদরের সাথে সঙ্গতিরেখে হোটেল সেক্টরে নিম্নতম মজুরির দাবি জানানো হয়।
সর্বশেষ ২০১৭ সালে হোটেল সেক্টরে নিম্নতম মজুরি ঘোষণা হলেও অদ্যাবধি আর কোন নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করা হয় নি। অথচ প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেলেও সে অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধি না হওয়ায় অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের মত হোটেল শ্রমিকরা নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
হোটেল ও রেস্টুরেন্ট সেক্টরে প্রায় ৩০-৩৫ লাখ কর্মরত শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। এদের উপর তাদের পরিবারসমূহের জীবন-জীবিকাও নির্বাহ করে। ফলে দেশের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে জাতীয় উৎপাদনশীলতা ও জাতীয় জীবনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাছাড়া সারা বিশে^ পণ্যখাতের চেয়ে সেবা খাতে বিনিয়োগ বেশি আকর্ষিত হওয়ায় বাংলাদেশের হোটেল রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন খাত বিদেশী বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এ প্রেক্ষিতে সিলেট অঞ্চল পর্যটন খাতের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। অথচ এ অঞ্চলের হোটেল রেস্টুরেন্ট সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরা শ্রম আইনের সুবিধা হতে বঞ্চিত হলে এবং এ সেক্টরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তৈরি করতে না পারলে এ সেক্টর বিনিয়োগের অগ্রাধিকার থেকে ছিটকে পড়ার আশংকা রয়েছে। তাই জাতীয় অর্থনীতি ও জাতীয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বিবেচনা থেকেও হোটেল সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র প্রদান তথা শ্রম আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষিতে শ্রম উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ ও উদ্যোগ প্রত্যাশা করে শ্রমআইন অনুযায়ী নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র, সাপ্তাহিক ছুটি প্রদানসহ শ্রমআইন বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত দাবি সমূহ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানানো হয়।
(১) বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬ এর ৫ ধারা অনুযায়ী সকল হোটেল -রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র ও নিয়োগপত্র প্রদান করতে হবে।
(২) বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬ এর ১০৩ ধারা অনুযায়ী সকল হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিককে সাপ্তাহিক দেড় দিন ছুটি প্রদান করতে হবে।
(৩) বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬ এর ১০০ ধারা অনুযায়ী সকল হোটেল-রেস্টুরেন্টে দৈনিক ৮ ঘন্টা কর্মদিবস এবং ১০৮ ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত কাজে দ্বিগুণ মজুরি নিশ্চিত করতে হবে
(৪) বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬ এর ২(২ক) ধারা অনুযায়ী সকল হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিককে প্রতিবছর দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবে উৎসব ভাতা প্রদান এবং ১১৮ ধারা অনুযায়ী বছরে ১১ দিন উৎসব ছুটি প্রদান করতে হবে।
(৫) বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬ এর ১১৫ ধারা অনুযায়ী সকল হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিককে বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি, ১১৬ ধারা অনুয়াযী ১৪ দিন অসুস্থ্যতাজনিত ছুটি এবং ১১৭ ধারা অনুযায়ী প্রতি ১৮ দিন কাজে ১ দিন বার্ষিক ছুটি প্রদান করতে হবে।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *