পর্যটন রক্ষা এবং বৈষম্য দূরীকরণ জামিউল আহমেদ

সিলেট নিউজ টাইমস্ ডেস্ক :   নতুন অন্তর্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার এক মাস পার হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত পর্যটনের জন্য একজন উপদেষ্ঠা পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি একজন সচিব। কিন্তু কেন? বলা হচ্ছে উপযুক্ত লোক নাকি পাওয়া যাচ্ছেনা। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? মনে হয়না যেহেতু ঠিকমত চাইলেই তা সম্ভব হত। তাহলে কি চাওয়া হচ্ছেনা? হয়তো ঠিকমত হচ্ছেনা নাহয় স্বদিচ্ছার অভাব রয়েছে। কিন্তু কেন এই সদিচ্ছার অভাব? হয়তো যতটুকু গুরুত্ব পাওয়ার ততটুকু পাচ্ছেনা।

তাহলে দেখা যাক এই গুরুত্ব না পাওয়ার কারণগুলো কি? এজন্য প্রথমেই মনে রাখতে হবে পর্যটন সব সময়েই যতটুকু গুরুত্ব পাবার ততটুকু পায়নি, এটি নিরেট সত্য। কেন পায়নি? তাহলে একটু গোড়ায় যাওয়া দরকার। স্বাধীনতা লাভের পর পর দেশ যখন একটা ধ্বংশস্তূপের মধ্যে ছিল তখনই এই পর্যটন তার যাত্রা শুরু করেছিল। তার কারণ ঐ সময়ে নতুন হিসেবে একমাত্র পর্যটন খাতই ছিল সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়। কেননা পর্যটনের বিকাশ এবং উন্নয়নের জন্য যে দুটি জিনিষ লাগবেই তা আমাদের ছিল অবারিল। যেমন পর্যটন সম্পদ এবং মানব সম্পদ।

তারপর কি হলো? তারপর পর্যটন “বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন” নামে তার যাত্রা শুরু করলো এবং প্রথম দিকে বেশ ভালোই এগুচ্ছিল। কারণ, তখন সে নিজের কোন মন্ত্রণালয় না পেলেও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেও স্বস্বাধীনভাবে চলতে পারছিল। কিন্তু যখনই নিজের জন্য একটি মন্ত্রণালয় পেয়ে গেলো তখনই সরাসরি আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে এসে গেলো। এতেকরে পর্যটনের কপালটাও পুড়লো। কেন কপাল পুড়লো? ঐ যে আমলাতন্ত্রের বদ খাসলতের শিকার হয়ে গেলো। কেন না আমলারা পর্যটনকে পর্যটনের নিয়মে চলতে না দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত চালাতে শুরু করলো।

তাহলে সরকার কি করলো? সরকার কখনো আন্তরিক ছিলনা এবং ধারণাও ছিলনা। এই সুযোগ নিয়েছে আমলারা। এতে পর্যটন উন্নয়নের জন্য যা যা করার দরকার ছিল তা না করে অন্যটা করা হয়েছে এবং এক সরকার এসে আগের সরকারের সব উদ্যোগকে বুড়িগঙ্গায় চুবিয়ে দিয়ে নিজেদের মত কিছু করতে চেয়েছে। তাতে উন্নয়নের যেটুকুইবা উদ্যোগ ছিল তাও ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে। কাজের মাঝে কাজ হয় লোকদেখানো সব কর্মাকাণ্ড যার কোনকিছুই পর্যটন উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না।

কিন্তু বেসরকারি খাততো ছিল, তারা কি করেছে? বেসরকারি খাত এসেছে অনেক পরে। তারপরও এদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর সমস্যা। কি সমস্যা? যেমন কেউ কাউকে না মানা, নিজেদের মধ্যে চরম অনৈক্য এবং অযোগ্য নেতৃত্ব যা বেসরকারি খাতকে পঙ্গু বানিয়ে রেখেছে। এই সুযোগটাও নিয়েছে আমলারা। এতেকরে শুধু তেলবাজ আর মতলববাজ এবং স্যার স্যার বলা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে পর্যটন উন্নয়নের কোন কাজ বলতে যা বুঝায় তার কিছুই হয়নি। যেজন্য বলা হচ্ছে এই বায়ান্ন বছর পরও পর্যটন নাকি এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে।

তাহলে এখন কি করতে হবে? পর্যটনের জন্য করার কোন শেষ নেই। কেন না পর্যটন নিজে এক টন আর সমস্যা জমা হয়েছে কয়েক টন। এত সমস্যা্র সমাধান চাইলেও এই অল্প সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা করতে পারবেনা। এজন্য এই সরকারকে যা করতে হবে সমস্যাগুলোর মধ্যে যেগুলো মৌলিক এবং নির্বাচিত সরকার চাইলেও করতে পারেনা বা পারেনি সেগুলোর একটা সুরাহা করে দিয়ে যেতে পারে। এতে লাইনচ্যুত হওয়া এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি তার সঠিক পথ খুঁজে পাবে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে এই পথ ধরে চলবে। তারপর বাকী সমস্যাগুলোর সমাধান একে একে অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মত করে এগিয়ে যাবে। তাতে পর্যটনও তার নিজের যাত্রা পথ খুঁজে পাবে এবং উন্নয়নের সঠিক ধারায় ফিরে আসবে।

এজন্য সুনির্দিষ্টভাবে কি কি করতে হবে? হ্যা, মোটাদাগে কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কার বা আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যা অতীতে বহু চেষ্টা করেও এই আমলাতন্ত্রের সরাসরি বাধার কারণে সম্ভব হয়নি। তাই এজন্য যা যা করতেই হবে –

একঃ একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী মন্ত্রণালয় করতে হবে এবং অনতিবিলম্ভে। এর সাথে আর কোন কিছু জড়ানো যাবেনা। জড়ালে কি হয় তা আমরা বিমানের মত অলাভজনন এক শ্বেতহস্তীর নীচে চাপা পড়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

দুইঃ একটি কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো তৈরী করতে হবে। এজন্য বিদ্যমান “বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন” এবং “বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড” এর মত রাশভারি অথচ অকার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে এগুলোকে একিভূত করে একটি কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ে এসে স্বস্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়ে সুনির্দিষ্ট দায়-দায়িত্ব দিয়ে দিতে হবে।

তিনঃ বহুল প্রতিক্ষিত এবং গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সরকারি-বেসরকারি খাত কর্তৃক সর্বোসম্মতভাবে প্রণীত “একক পর্যটন আইন” এর খসড়াটি যা আমলাতন্ত্রের বাঁধার কারণে আইনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি তা অবশ্যই জরুরী ভিত্তিতে আইনে পরিণত করতে হবে। এতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি খাতের সবার স্বার্থ সুরক্ষিত হবে এবং পর্যটন উন্নয়নের পথও সুগম হবে।

চারঃ পর্যটনের মত একটি একক সর্ব-বৃহৎ শিল্প চলছে পরিকল্পনাহীনভাবে। এখন পর্যন্ত দুই দুইটা পর্যটন মহা-পরিকল্পনা প্রণয়ন করার পরও তা কার্যত বাস্তবায়নের অযোগ্য হয়েছে। এতে সময় এবং অর্থ দুটোরই অপচয় হয়েছে। তাই অনতিবিলম্ভে পাশের দেশ শ্রীলংকার ন্যায় বিশ্বব্যাংক বা অন্যকোন বিশ্বসংস্থার সহায়তা নিয়ে মাত্র তিন বা চার বছরের জন্য একটি “কৌশলগত পর্যটন পরিকল্পনা” বা ষ্ট্র্যাটেজিক ট্যুরিজম প্ল্যান প্রণয়ন করতে হবে। এটি না করা গেলে পর্যটনের জন্য পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবেনা।

পাঁচঃ পর্যটনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শুধুমাত্র সরকারি খাত নিয়ে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী যে কাউন্সিলটি রয়েছে সেটি এই বায়ান্ন বছরে মাত্র তিনটি সভা করতে পেরেছে। তাই এটিকে সংস্কার করে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের আনুপাতিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে ঢেলে সাজাতে হবে। তবে, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা সমিতির প্রতিনিধি ইত্যাদি বিবেচনায় না নিয়ে পর্যটন বিষয়ে সত্যিকার যোগ্য, অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকজন যাচাই-বাচাই করে নিতে হবে। এজন্য যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এদের নির্বাচন করে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের যথাযথ সম্মান দিয়ে পর্যটনের যেকোন নীতি-নির্ধারণী কাজে লাগাতে হবে।

সর্বোপরি, সরকারিভাবে একটি শ্বেতপত্র তৈরীর কাজ হাতে নিতে হবে এবং অনতিবিলম্ভে। এতেকরে, বিগত দিনে পর্যটনে কি ঘটেছিল এবং কোন প্রতিষ্ঠান বা কার কি ভুমিকা ছিল তা জানা যাবে। তখন সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা সহজ হবে। আশাকরি এবং নিশ্চিত করে বলতে পারি অন্তত এই কয়েকটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা গেলে পর্যটন উন্নয়ন আর বাঁধা গ্রস্থ হবেনা এবং সে তারমত করেই গতি নিয়ে চলতে পারবে। তবে, এজন্য বেসরকারি খাতকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এতে অবশ্য কাউকে না কাউকে এগিয়েতো আসতেই হবে।

চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম ষ্টাডিজ (সিটিএস)

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *