অপরিকল্পিত নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে মৎস্য খাত

নিউজ ডেস্ক:: মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেদের মতে, ‘মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা বলা হলেও আসলে বিষয়টি অপরিকল্পিত।

বাংলাদেশে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতের নিষেধাজ্ঞার মিল না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তাদের। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে জাটকার সংজ্ঞা নিয়েও।

বাংলাদেশে চলমান নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ভারত, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর জেলেরা ইলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ জেলেদের।

এসব বিষয় নিয়ে সরকার নতুন করে না ভাবলে মৎস্য সম্পদ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তবে জেলেদের এসব অভিযোগের জবাবে ভিন্ন কথা বলছে মৎস্য বিভাগ। তাদের মতে, তবে এসব বিধিনিষেধের কারণেই দেশে মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ছে। তাই সাময়িক অসুবিধা হলেও জেলেদেরকে এসব নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হবে।

নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল : প্রায় সারা বছরই উপকূলসহ দেশের কোনো না কোনো এলাকায় বন্ধ থাকে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ শিকার। এই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল শুক্রবার থেকে দেশে শুরু হচ্ছে ইলিশ শিকারে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ শিকার করতে পারবে না জেলেরা।

এ সময়ে সাগর থেকে নদ-নদীতে আসা মা-ইলিশ ডিম ছাড়ে বলছেন তারা। ২২ দিনের এই নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে না হতেই আগামী ১ নভেম্বর থেকে শুরু হবে জাটকা ধরা বন্ধের কাল।

৩০ জুন পর্যন্ত টানা ৮ মাস দেশের নদ-নদীতে অব্যাহত থাকবে তা। নিষেধাজ্ঞার আওতায় বন্ধ থাকবে লেজের শেষাংশ থেকে মাথা পর্যন্ত ১০ ইঞ্চি লম্বা কিংবা এর ছোট আকারের ইলিশ শিকার।

জাটকা ধরা বন্ধের এই সময় শেষে শুরু হবে মাছের ৬টি অভয়াশ্রমে ২ মাস মৎস্য শিকার বন্ধের নিষেধাজ্ঞা। এগুলোর পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত টানা ৬৫ দিন সাগরে বন্ধ রাখা হচ্ছে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা। এই ৬৫ দিনকেও আখ্যা দেওয়া হচ্ছে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন মৌসুম হিসাবে। এভাবে নানা ব্যাখ্যায় এলাকাভেদে আবার কখনো কখনো সারা দেশে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে জেলেদের।

নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন : বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞায় আমাদের ক্ষোভ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে এর যৌক্তিকতা নিয়ে। ১০ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে ইলিশকে বলা হচ্ছে জাটকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ জাটকার ওজন হয় ৬শ থেকে ৭শ গ্রাম পর্যন্ত। তার ওপর এগুলোর পেটে মিলছে ডিম। তাহলে এগুলো অপরিণত ইলিশ হলো কী করে? জাটকার এই বিতর্কিত সংজ্ঞার কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। দেখা গেল ডিমওয়ালা ইলিশ ধরার পর জাটকা আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে জেলেদের জাল। করা হচ্ছে জেল-জরিমানা। তা ছাড়া সারা বছরই যদি এভাবে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে তাহলে জেলেরা মাছ ধরবে কখন?’

বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন, ‘বছরজুড়ে এসব নিষেধাজ্ঞার ফল কী দাঁড়াচ্ছে? মাছের লালন-পালন করে বড় করব আমরা আর তা ধরে নিয়ে যাবে আশপাশের দেশের জেলেরা? ইলিশ যখন বড় হলো, শিকারের সময় এলো তখনই নিষেধাজ্ঞা! খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার, ভারত এবং থাইল্যান্ডে কিন্তু এত নিষেধাজ্ঞা নেই। তারপরও গত কয়েক বছরে ওইসব দেশে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে।

ট্রলার মালিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘দেশে ইলিশের বড় মৌসুম ১৫ মে থেকে ১৫ অক্টোবর। মোট ইলিশের প্রায় ৮১ ভাগই ধরা পড়ে এই সময়ে। অথচ তখনই জারি হলো ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। ভরা মৌসুমে যদি সাগরে মাছ ধরতে যেতে না পারি তাহলে খাব কী?’

পটুয়াখালীর আলীপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী জয়নাল সিকদার বলেন, ‘বিভিন্ন প্রজাতির ছোট ছোট মাছের প্রজনন মৌসুম হিসাব করে সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। ইলিশ ধরা জালের ফাঁস ৪ বর্গইঞ্চি। এ ফাঁসে রেণু পোনা দূর, ছোট মাছও ধরা পড়ে না। অথচ এই জালেও কেন মাছ ধরা বন্ধ করা হলো?’

বরগুনা জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল মাস্টার ও সাধারণ সম্পাদক দুলাল মাস্টার বলেন, একই সমুদ্রে মাছ ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের জেলেরা। ভারতে মাছের প্রজনন মৌসুমের জন্য বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠকে নির্ধারণ করে ২ মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়। আমাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে জ্যৈষ্ঠ এবং আষাঢ়। ফলাফল আমরা যখন নিষেধাজ্ঞার কারণে সাগরে যেতে পারিনা সেই সময় সাগরে দেদার মাছ ধরে ভারতীয় জেলেরা। দুই দেশের নিষেধাজ্ঞায় এই ফারাক কেন? আমাদের সমুদ্রসীমায় এসে কি মাছের প্রজনন মৌসুম বদলে যায়?’ নিষেধাজ্ঞাই যদি দেওয়া হয় তো ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হোক।’

আন্দোলনে জেলেরা : ট্রলার মালিক ফেডারেশনের নেতা মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘বিতর্কিত এসব নিষেধাজ্ঞা বিশেষ করে সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে উপকূলীয় জেলাগুলোয় দফায় দফায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে। একই সমুদ্রে দুই ধরনের আইন চলতে পারে না। এমন অনেক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যেগুলোর কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। মৎস্য সম্পদ রক্ষা ও বৃদ্ধিতে যেসব কমিটি হয় সেখানে জেলেদের প্রতিনিধিত্ব থাকলে এসব সমস্যা হতো না। আমরাও চাই মৎস্য সম্পদের বৃদ্ধি ঘটুক। কিন্তু এখন যেভাবে চলছে তাতে অন্য পেশায় চলে যেতে হবে আমাদের।’

মৎস্য বিভাগের বক্তব্য : জেলেদের এসব অভিযোগ নিয়ে আলাপকালে বরিশালের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল কুমার দাস বলেন, ‘যখন আইন করা হয় তখন আলাদা করে কারও কথা ভেবে হয় না।

প্রয়োগ ক্ষেত্রে গিয়ে যেসব জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে তা অবশ্যই সরকার বিবেচনা করবে।’ জেলেদের দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে তারা বড় ফাঁসের জাল দিয়ে সাগরে শুধু ইলিশ ধরছেন। আশা করি সরকার এটি নিয়ে ভাববে।’

জাটকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পেটে ডিম কিংবা ওজন দেখে এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। আমরা চাইছি যে ১০ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে নিচে কেউ ইলিশ ধরবে না। এতে ইলিশের আকার এবং বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত হবে।’

বছরজুড়ে নানা নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জাটকা নিধন যখন বন্ধ থাকে তখন বড় ইলিশ ধরায় কিন্তু নিষেধ থাকে না। তাছাড়া প্রতিটি নিষেধাজ্ঞার মেয়াদেই কোনো না কোনো বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

তবে ইলিশের ভরা মৌসুমে ছোট ছোট মাছের প্রজনন মৌসুম নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে সেটা নিয়ে গবেষণা চলছে। আশা করি প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা ভবিষ্যতে আর থাকবে না।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *