রানি এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিন যা ঘটেছিল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক::  ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা ম্যারি উইন্ডসর আর নেই। বৃহস্পতিবার ৯৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান বলে বাকিংহ্যাম প্যালেস জানিয়েছে।

১৯২৬ সালের ২২ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সেই হিসাবে তার বয়স চলছিল ৯৬ বছর। সিংহাসনের অধিকার পাওয়ার পর ৭০ বছর পার করেছেন তিনি। তিনিই প্রথম এত সময় সিংহাসনে থাকা কোনো রানি।

ব্রিটেনের হাজার বছরের ইতিহাসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি। ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর যুবরাজ ফিলিপের সঙ্গে বিয়ে হয়।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৯৫৩ সালে, সেদিন উৎসবে মেতে উঠেছিল লন্ডনের মানুষ। অভিষেক অনুষ্ঠানে তার সহচরী হয়েছিলেন এমন দুজন বিবিসিকে জানিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক দিনটির কথা।

১৯৫৩ সালের ২ জুন। সেদিন সবার দৃষ্টি লন্ডনের দিকে। খুশিতে, আনন্দে, উত্তেজনায় কাঁপছে এই শহর। শুধু লন্ডন নয়, পুরো কমনওয়েলথ জুড়েই সবার দৃষ্টি তখন এই অনুষ্ঠানের দিকে।

জুনের সেই সকালে আবহাওয়া কিছুটা ঠাণ্ডা, তবে সকালে যে বৃষ্টি ছিল তা থেমে গেছে, এবং আকাশে সূর্য দেখা যেতে পারে এমন আশাও দেখা যাচ্ছিল।

অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য রানি বেরুবেন তার লন্ডনের ঠিকানা বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে। সেখান থেকে তিনি যাবেন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে, যেখানে মুকুট পরানোর মাধ্যমে তার অভিষেক সম্পন্ন হবে।

সেদিন শহরজুড়ে সব ভবন ঢাকা পড়ে গেছে অভিষেক উৎসবের সাজে, কেবল বাকিংহাম প্রাসাদের পূর্বদিকের সম্মুখভাগটাই যেন বাদ পড়েছিল।

রানি যখন বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে যান, তখন সহচরী হিসেবে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বাছাই করা হয়েছিল ছয় তরুণীকে।

এই ছয়জনের একজন ছিলেন লেডি অ্যান গ্লেনকোনের, যিনি তখন পরিচিত ছিলেন লেডি অ্যান কুক নামে। তাদের দায়িত্ব ছিল দুটি: রানির দীর্ঘ পরিচ্ছদের ভেলভেটের শেষ প্রান্তভাগ ধরে রাখা, আর সেই সঙ্গে নিজেদেরকেও সুন্দর সাজে ফুটিয়ে তোলা।

রানি এলিজাবেথের বয়স তখন ২৬। তিনি আবদার করেছিলেন যে, তার অভিষেক অনুষ্ঠানটি যেন সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হয়। রাজপরিবারের এই অনুষ্ঠানটির কিছু কিছু ঐতিহ্য বহু শতকের, ৯০০ বছর আগে থেকে চলছে। কিন্তু এবার এই অনুষ্ঠানটি যত মানুষ দেখার সুযোগ পাবেন, তেমনটি এর আগে কখনো ঘটেনি।

বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে থেকে সেদিনের উৎসবমুখর লন্ডনের পরিবেশ বর্ণনা করছিলেন টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার। শুধু প্রাসাদের সামনে নয়, যে পথ ধরে রানি যাবেন, তার দুপাশেই ছিল উৎসাহী মানুষের ভিড়। সেই পথের নানা জায়গায় মোতায়েন ছিলেন আরও কয়েকজন ধারাভাষ্যকার। সাত ঘণ্টা ধরে সেদিনের অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হয়েছিল টেলিভিশনে।

লেডি অ্যান মনে করতে পারেন, উত্তেজনায় ঠিকমত ঘুমাতে পারেননি তিনি।

তিনি বলেন, আমার মনে আছে, সেই রাতে আমি মেঝেতে ঘুমিয়েছিলাম, কারণ রানির অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে তখন আসলে লন্ডনে এত মানুষ এসেছিল যে সবাইকে রাতে শোওয়ার জায়গা পর্যন্ত দেয়া যাচ্ছিল না। আমরা ছিলাম আমার চাচার বাড়িতে এবং সেখানে আমার মা-ও ছিলেন। আমরা দুজন একসঙ্গে সাজগোজ করলাম। এলিজাবেথ আর্ডেন থেকে একটা মেয়ে এসেছিল আমাদের সাজাতে।

রানির শোভাযাত্রা দেখতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তার দুপাশে লাইনে দাঁড়িয়ে। অনেকে রাতে বৃষ্টির মধ্যে সেখানেই ঘুমিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র আট বছর আগে, যুদ্ধের পর ধুসর লন্ডন নগরী সেই প্রথম যেন কোন উৎসবের জন্য নানা রঙে সেজে উঠেছে।

সোনায় মোড়ানো যে শকটে করে রানি যাবেন, সেটির অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছে মানুষ। অ্যাডমিরালটি আর্চের নীচ দিয়ে যখন রানির শকট এগিয়ে আসলো, হর্ষ-ধ্বনি দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় মানুষ।

সেদিনের শোভাযাত্রায় রানির আরেক সহচরী ছিলেন লেডি জেইন ভেইন টেম্পেস্ট স্টুয়ার্ট। তিনি যে গাড়িতে ছিলেন, সেটিতেই ছিল প্রিভি পার্স নামে পরিচিত গোপন রাজকীয় থলি, আর সেই থলি যার কাছে থাকে, তিনিও একই গাড়ির আরোহী। ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ রাজথলি কেবল অভিষেক অনুষ্ঠানের সময়েই বাইরে আনা হয়।

রানিকে বহনকারী রাজকীয় শকট এসে পৌঁছালো ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে।

রানির ছয় সহচরীর জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত। রানি যখন ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির দিকে হেঁটে যাবেন, তখন তার ভারী পোশাকের দীর্ঘ শেষ প্রান্তটি তাদের ধরে রাখতে হবে, এবং একসঙ্গে হেঁটে যেতে হবে।

অবশেষে রানি গাড়ি থেকে নামলেন ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবিতে ঢোকার জন্য।

লেডি অ্যান বলেন,‘তখন আমার মনে হয়, রানি বলছিলেন, এই মেয়েরা, তোমরা কি প্রস্তুত? তারপর আমরা রওনা হলাম। আমরা সবাই যেন সমান তালে হাঁটি, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’

আরেক সহচরী লেডি জেন তখন খুবই নার্ভাস হয়ে আছেন।

‘আমার খুবই ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিল আমি অজ্ঞান হয়ে যাব, কিংবা কোন একটা ভুল করে ফেলবো, অথবা রানির পোশাকের যে শেষ প্রান্ত আমি ধরে আছি, সেটা আমার হাত থেকে পড়ে যাবে।’

আড়াইশো জনের বিশাল এক শোভাযাত্রা শুরু হলো ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির দিকে। রানির পাশে ডিউক অব এডিনবারা। ভেতরে তখন সারা বিশ্ব থেকে আসা ৮ হাজার অতিথি। রানি যখন শপথ নিচ্ছিলেন, তা দেখছিলেন লেডি অ্যান এবং লেডি জেন। তারপর আসলো অভিষেক অনুষ্ঠানের সেই মূহুর্তটি, যেটি টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখানো নিষেধ। রানিকে এখন পবিত্র তেল মাখিয়ে অভিষিক্ত করা হবে।

রানির পরনের যে পোশাক সেটি এরপর খুলে ফেলা হয়। খুলে নেয়া হয় সব অলংকার। তাকে পরানো হয় একেবারেই একটি সাদা রঙের সাদামাটা পোশাক।

লেডি জেন বলেন, “এসময় আমরা খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলাম। রানিকে খুবই নাজুক দেখাচ্ছিল, এমনকি তাকে ২৬ বছরের চাইতেও অনেক কম বয়সী বলে মনে হচ্ছিল। তার গায়ে তখন সাদা একটি কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই, কোন সামান্য অলংকার পর্যন্ত নেই।”

এরপর ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির ডিন পবিত্র তেলের একটি পাত্র নিয়ে আসলেন আর্চবিশপের কাছে। এরপর আর্চবিশপ রানিকে তেল মাখিয়ে অভিষিক্ত করার জন্য চলে গেলেন সামিয়ানার নীচে সবার আড়ালে।

লেডি অ্যান বলেন, রানির কপালে যখন তেল মাখিয়ে তাঁকে অভিষিক্ত করা হবে, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মূহুর্ত। তার গায়ে তখন একটা সাদা কাপড়, যেটা মার্কুয়েজ অব চামলি’র তাকে পরিয়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি এর আগে কখনো এরকম কাজ করেছেন বলে মনে হয় না।

‘পোশাকটির এক প্রান্তে অনেক হুক আর বোতামের ঘর ছিল, যার ফলে তিনি কাজটা আসলে ঠিকমত করতে পারছিলেন না। কাজেই শেষ পর্যন্ত ডিউক অব নরফোককে এগিয়ে আসতে হলো, তিনি রানির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি তখন না ভেবে পারছিলাম না, রানি তার শিরদাঁড়ায় মার্কুয়েজ অব চামলির হাতের আঙ্গুলের স্পর্শের সময় কী ভাবছিলেন।’

রানিকে নিয়ে রাজকীয় বহর এরপর আবার লন্ডনের রাস্তা ধরে ফিরে চললো। যখন তার গাড়ি আবার বাকিংহাম প্রাসাদে ফিরে এলো, সেখান থেকেও সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল সেই দৃশ্য।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *