‘বালিশচাপা’ দিতে চেয়েছিলেন ছোটমণি নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক!

সিলেট নিউজ টাইমস্ ডেস্ক:: কান্না সহ্য করতে না পেরে সিলেটে ছোটমণি নিবাসে মাত্র দুই মাস ১১ দিন বয়সী নাবিল আহমদকে রাগের মাথায় হত্যা করেছেন বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন গ্রেপ্তার হওয়া আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকা।

কিন্তু বিষয়টি নাবিল হত্যার মতোই ‘বালিশচাপা’ দিতে চেয়েছিলেন সিলেট ছোটমণি নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক রোকন দেব।

শনিবার (১৪ আগস্ট) আদালতে জবানবন্দিকালে আয়া সুলতানা জানান, ঘুমানোর সময় বেশি কান্নাকাটি করত শিশুটি। ওই দিন আরও বেশি কাঁদছিল। শিশুটিকে শয্যা থেকে ফেলে দিয়ে পরে বালিশচাপা দেন পাষণ্ড সুলতানা। এতে নাবিল মারা যায়।

চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিকে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এলাকায় এক মানসিক ভারসম্যহীন নারী একটি ফুটফুটে ছেলেসন্তান জন্ম দেন। সেখান থেকে উপজেলা সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে সিলেট নগরীর বাগবাড়ি এলাকার সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ছোটমণি নিবাসে ঠাঁই হয় নাবিল আহমদের। কিন্তু সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকার পরও জন্মের মাত্র আড়াই মাসের মাথায় গত ২২ জুলাই রাতে নির্মমভাবে খুন হতে হয় অবুঝ এই শিশুকে।

ঘটনাটি ওই রাতেই ছোটমণি নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক রোকন দেবকে জানালে আয়া সুলতানাকে চুপ থাকতে বলেন তিনি। আয়াকে বলা হয়েছিল, ঘটনাটি বাইরের কেউ জানলে চাকরি যাবে, হত্যার দায়ে সবাইকে জেলও খাটতে হবে। এ জন্য সুলতানা ফেরদৌসী ঘটনাটি প্রকাশ করেননি।

শনিবার সন্ধ্যায় সিলেট মহানগর আদালতে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমানের আদালতে সুলতানা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলে তা ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করা হয়।

সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আবু ফরহাদ বলেন, শনিবার দুপুরে আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকাকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করার সময় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। এরপর জবানবন্দি গ্রহণের জন্য আবেদন করলে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা জবানবন্দি দেন তিনি। এরপর আদালত থেকে তাঁকে কারাগারে পাঠনো হয়।

সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সিলেট নগরের বাগবাড়ি এলাকায় ছোটমণি নিবাস। গত ২৩ জুলাই সকালে নিজ শয্যায় দুই মাস ১১ দিন বয়সী এক শিশুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ঘটনায় সিলেট কোতোয়ালি থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে মামলাটি পর্যালোচনা করার সময় পুলিশের একটি দল সেখানে গিয়ে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করে। তাতে শিশুটিকে হত্যার চিত্র পাওয়া যায়। ২২ জুলাই রাতে কর্তব্যরত আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকা শিশুটিকে হত্যার চিত্র ধরা পড়ে সিসি ক্যামেরায়।

নাবিল হত্যার বিষয়টি বালিশচাপাই থাকতো। কিন্তু গত ১২ আগস্ট রাতে কোতোয়ালি থানা পরিদর্শনে আসেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) উপ-কমিশনার (ডিসি উত্তর) আজবাহার আলী শেখ। এসময় শিশু নাবিলের অপমৃত্যু মামলাটি তার দৃষ্টিগোচর হয়। বিষয়টি তাঁর কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় রাত ১১টায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আবু ফরহাদ এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাহবুবসহ পুলিশ ফোর্স নিয়ে বাগবাড়ির ছোটমনি নিবাসে ছুটে যান ডিসি আজবাহার আলী শেখ।

সেখানের সিসি ক্যামেরায় শিশু নাবিল খুনের পুরো ঘটনাটি রেকর্ড হয়েছিলো। ক্যামেরায় ধারণ হয় সুলতানা কীভাবে নাবিলকে ছুড়ে ফেলে এবং বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে।

সিসি ফুটেজ দেখে আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকাকে তাৎক্ষণিকভাবে আটক করার নির্দেশ দেন আজবাহার আলী শেখ। পরে সুলতানাকে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।

পুলিশ জানায়, সিসি ক্যামেরার ওই দৃশ্য দেখে গত বৃহস্পতিবার রাতে ছোটমণি নিবাস থেকে আয়াকে আটক করে পুলিশ। শুক্রবার রাতে ওই ঘটনায় কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুব মণ্ডল বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় আয়া ফেরদৌসী সুলতানাকে।

ছোটমনি নিবাসের আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকা (৪৫)-কে ঘটনার ২০ দিন পর পুলিশ আটক করে। সুলতানা নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার চেলারচর গ্রামের শাহাব উদ্দিনের স্ত্রী। তিনি ২০০৩ সাল থেকে ছোটমনি নিবাসে আয়া হিসেবে কর্মরত আছেন।

নাবিল হত্যার বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য ছোটমণি নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক পরামর্শ দিয়েছিলেন আয়া সুলতানা ফেরদৌসীকে।

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ জুন গোয়াইনঘাট থানাপুলিশের মাধ্যমে শিশুটিকে ছোটমণি নিবাসে দেওয়া হয়েছিল। এক ভবঘুরে নারীর সন্তান ছিল শিশুটি। তার নাম রাখা হয়েছিল নাবিল আহমদ। ছোটমণি নিবাসে ১২ জুন থেকে তাকে রাখা হয় নবজাতক দপ্তরে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের আয়া সুলতানা ফেরদৌসী পরিচর্যার দায়িত্বে ছিলেন। ২৩ জুলাই সকালে শিশুটিকে তার শয্যায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে উল্লেখ করে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে পুলিশকে জানানো হয়। পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে শিশুটিকে দাফন করা হয়।

পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সুলতানা ফেরদৌসী জবানবন্দিতে তাঁর সঙ্গে ছোটমণি নিবাসের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা রোকন দেবকে ঘটনাটি জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।

শনিবারের জবানবন্দিতে সুলতানা বলেন, শিশুটি ছোটমণি নিবাসে আসার পর থেকে জ্বালাতন করছিল। এর মধ্যে বেশি জ্বালাত রাতে। ঘটনার দিন রাতে খাওয়ানোর পরও কান্নাকাটি করে শিশুটি। রাত ৯টার দিকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ান। এরপর আবার কান্না জুড়ে দেয় শিশুটি। একপর্যায়ে রাগ করে শয্যা থেকে নামাতে গিয়ে নিচে পড়ে যায়। এতে মাথায় আঘাত পায় শিশুটি। নিস্তেজ হয়ে পড়লে শিশুটিকে আবার শয্যায় রেখে বালিশচাপা দিয়ে রাখেন। ঘটনাটি তিনি তত্ত্বাবধায়ক রোকন দেবকে গিয়ে জানান। ঘটনাটি সকালে দেখা হবে বলে তত্ত্বাবধায়ক তাঁকে চুপ থাকতে বলেন। বাইরের কাউকে না জানানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, কেউ যাতে না জানে।

তত্ত্বাবধায়কের কথামতো ওই রাতে কাউকে কিছু বলেননি উল্লেখ করে জবানবন্দিতে ফেরদৌসী আরও বলেন, পরদিন সকালে তত্ত্বাবধায়কই সমাজসেবা অধিদপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানান। ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে বলে তত্ত্বাবধায়কের পরামর্শে তিনি এ কথা বলেন। এরপর তাঁকে কারণ দর্শাও নোটিশ করে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

সুলতানা ফেরদৌসীর জবানবন্দিতে তত্ত্বাবধায়কের নাম আসা প্রসঙ্গে কোতোয়ালি থানার ওসি এস এম আবু ফরহাদ বলেন, জবানবন্দিতে এ ঘটনায় জড়িত কারও নাম এলে আসামি করা হবে। তবে তার আগে তদন্ত করে জবানবন্দির তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে ছোটমণি নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক রোকন দেবের মোবাইল ফোনে কল দিলে সেটি ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *