১৯৬২ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসা সব সেনা কমান্ডার যা করেছেন, যা পেয়েছেন সে সব উল্টে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো ঘটনা ঘটার ঝুঁকি সেনাবাহিনী নিতে পারবে না, নেবে না। এটা যুক্তির কথা, বাস্তবতা। সুতরাং সু চির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে নিজেদের তৈরি সংবিধানে সব হাত-পা বেঁধে ২০১৫ সালে নামে মাত্র সু চিকে ক্ষমতায় বসার সুযোগ দেয়। হতে পারে আইনগতভাবে সব দায় সু চি সরকারের ওপর পড়বে বিধায় সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধন চালায়। এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য সু চির রাজনীতি নিঃশেষ করার জন্য আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে সু চিকে ওকালতি করতে বাধ্য করে। যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হিরো থেকে সু চি ভিলেনে পরিণত হন। রবীন্দ্রনাথের ‘পণরক্ষা’ কবিতা পড়া থাকলে হয়তো সু চি এই ভুল করতেন না। দুর্গেশ দুমরাজের মতো প্রভুর কর্মে বীরের ধর্মে বিরোধ মেটাতে দুর্গদুয়ারে জীবন বিসর্জন দিতেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সু চিকে আর বাড়তে দেওয়া হবে না, সেটা ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল দেখেই বোঝা গেছে। নির্বাচনে সেনাসমর্থিত দলের শোচনীয় ব্যর্থতায় ২০০৮ সালের সংবিধান ও বর্তমান সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের ক্ষমতার বিরুদ্ধে হুমকিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, সু চির দলের ব্যাংক অ্যান্ড ফাইলের মধ্যে গত কয়েক বছরে চীনবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং অজুহাত তোলার একটা সুযোগ যখন আছে, সেটিকে সেনাবাহিনী হাতছাড়া করতে চায়নি। কারচুপি হয়েছে, এই অভিযোগে নির্বাচনের ফল বাতিল করে আপাতত এক বছরের জন্য জরুরি আইন জারি করা হয়েছে। সব ক্ষমতা এখন সেনাবাহিনীর হাতে। ইয়াঙ্গুনসহ কিছু বড় শহরে সু চির পক্ষে মানুষের বিক্ষোভ চলছে। আগের মতোই কিছুদিনের মধ্যে এসব মিলিয়ে যাবে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব কড়া কড়া কথা বলছে, যা তারা আগেও অনেক বলেছে। এসব বিক্ষোভ ও কথায় সেনা কর্তৃপক্ষকে কর্ণপাত করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা তাদের সামনে আপাতত নেই। নতুন কিছু বিধি-নিষেধ এলেও সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞায় পশ্চিমা বিশ্ব যাবে না। চীনের পরে মিয়ানমারের অন্য অবলম্বন আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কঠিন কথা এ পর্যন্ত কেউ বলেনি। আমেরিকার সঙ্গে কোনো রকম সামরিক সংঘাত হলে মিয়ানমার হবে চীনের লাইফ লাইন, অর্থাৎ বেঁচে থাকার অবলম্বন। চীন বলছে, সামরিক অভ্যুত্থান নয়, মিয়ানমারের মন্ত্রিসভায় রদবদল হয়েছে। আমেরিকার নতুন প্রশাসনের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরো অবনতি হওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর ইস্যু, তাইওয়ান, হংকং এবং দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বন্দ্ব নিয়ে জো বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের মন্তব্যে চীন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এত কিছু জটিল সমীকরণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কী হতে চলেছে, সেটাই আমাদের জন্য মুখ্য বিষয়। এটা বোঝার জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দায়িত্বগ্রহণকারী নতুন মন্ত্রীদের আরো কিছু সময় দিতে হবে। তাঁরা সব দিক পর্যালোচনা করে তারপর পদক্ষেপ নেবেন। একতরফাভাবে কিছুই হবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে গত কয়েক মাসে চীনের পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক ছিল। সু চির সরকারের চেয়ে মিয়ানমার সেনা কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী, এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি তারা চীনের মধ্যস্থতায় দেখানোর চেষ্টা করতে পারে। রাজনীতিতে এমন হয়, যার উদাহরণ লেখার মাঝখানে দিয়েছি। তবে সেটা কতখানি সফল হবে তা বহু ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভরশীল, যার সব কিছু এখন এককভাবে চীন বা মিয়ানমারের হাতেও নেই। বিশ্বের বড় পক্ষগুলো এখানে খেলতে চাইবে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখা কঠিন হলেও বাস্তবতা তার চেয়ে আরো বেশি কঠিন। সু চির সরকার পাঁচ বছরে কিছুই করতে পারেনি, বরং সব কিছু আরো পেছনের দিকে গেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাইলে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গেই বসতে হবে, অন্য কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং সে পথ সুগম করার স্বার্থে অযথা সু চির জন্য অন্তত আমাদের মায়াকান্না করার কোনো প্রয়োজন নেই।
সূত্র:- কালের কন্ঠ।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
[email protected]