‘আমার সাক্ষী ভুল, এ চার্জশিট মানি না’

সিলেট নিউজ টাইমস্ ডেস্ক:: ২০০১ সালের ১৬ জুন বোমা হামলা মামলায় ১৯ বছরের মাথায় আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন এই বোমা হামলার প্রধান টার্গেট সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। সোমবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রথম বিচারক শেখ রাজিয়া সুলতানার আদালতে সাক্ষী দেন তিনি।

প্রায় ৩২ মিনিট ধরে দেয়া সাক্ষীতে শামীম ওসমান আদালতে মামলার চার্জশিট নিয়ে অসঙ্গতি রয়েছে বলে সে দিনের বোমা বিস্ফোরণের আগে ও পরের বিশদ বর্ণনা তুলে ধরেন।

এ সময় আদালতকে তদন্ত কর্মকর্তাকে দেয়া সাক্ষ্য ও চার্জশিটে উল্লেখ করা বর্ণনার কোনো মিল নেই বলে দাবি করে তিনি বলেন, আমি এই চার্জশিট ও অভিযোগ মানি না। আমার মতো অনেক সাক্ষীরই সাক্ষ্যের কোনো মিল চার্জশিটে নেই।

মামলার বাদী ও আইনজীবীরা পুন:তদন্তের দাবি জানালে বিচারক এ ব্যাপারে আবেদন (পিটিশন) দায়ের করতে আদালতের পিপিকে নির্দেশ দেন।

সাক্ষ্য প্রদান শেষে শামীম ওসমান গণমাধ্যমের সামনে বলেন, ‘ঘটনার দিন ঘটনাস্থল আওয়ামী লীগ অফিসে আমার নিজ এলাকার মুরব্বি ওবায়দুল্লাহ একটি ইংরেজিতে লেখা আবেদন নিয়ে আসেন। সেখানে চারটি পাসপোর্ট নাম্বার ছিল। আবেদনটি মূলত ছিল ওবায়দুল্লাহ ও তার পরিবার আমেরিকা যাবে। আমি যেন সেখানে একটি সুপারিশ করে দিই। এক পর্যায়ে আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি এটাতে আমি সুপারিশ করতে পারব না।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময় ওবায়দুল্লাহ সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে আমার টেবিল চাপড়াতে থাকেন এবং খুব চিৎকার করে বাজে ভাষায় আচরণ করতে থাকেন। ওই ঘটনার ফাঁকেই দুই-একজন কেউ বা কারা একটি ব্যাগ আমার টেবিলের নিচে রেখে চলে যায়। সেই দৃশ্যটি আওয়ামী লীগ নেতা ও মামলার বাদী অ্যাডভোকেট খোকন সাহা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এর মধ্যেই ওবায়দুল্লাহ বের হয়ে যান। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই ঘটনায় ২০ জন মানুষ নিহত হন।

শামীম ওসমান বলেন, এ ঘটনায় আমিসহ গুরুতর আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমি সদর থানার ওসিকে ডেকে নিয়ে কথা বলি। সদর থানার সেই সময়কার ওসিকে ওবায়দুল্লাহর ঘটনাটি জানিয়ে বলি সরাসরি ওবায়দুল্লাহর বাসায় যেতে। তার বাড়িতে গিয়ে খবর নিতে তাদের বাসার চারজনের কোনো পাসপোর্ট আছে কিনা। সেই সময় ওসি সাহেব ওবায়দুল্লাহর বাড়িতে গিয়ে তাদের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো পাসপোর্ট পাননি।

তিনি বলেন, সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওবায়দুল্লাহকে আটক করে থানায় নিয়ে যান কিন্তু ওবায়দুল্লাহর বয়স বেশি ছিল এবং তার স্ত্রী-সন্তানরা থানায় গিয়ে প্রচণ্ড হৈ চৈ করেন। এতে ওসি বিব্রত হয়ে সদর থানার পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে চলে যান। ওবায়দুল্লাহর পরিবারের সদস্যরা ওসির রুমেই অবস্থান নেন। পরের দিন ওবায়দুল্লাহর পরিবার চলে যাওয়ার পর ওসির রুমের ড্রয়ার থেকে হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা উদ্ধার হয়। এ ঘটনাটি আমি ১৬ জুনের পর সাক্ষী দেয়ার সময় বলেছিলাম। কিন্তু এই বিষয়গুলো সাক্ষীতে সম্পৃক্ত করা হয়নি।

শামীম ওসমান আরও বলেন, আজকে ওবায়দুল্লাহ কোথায়। উনি কি আকাশে উড়ে গেলেন, না মাটির নিচে চলে গেলেন। তাকে তো আর কোথায় দেখা গেল না গত ১৯ বছরে। সেই সময় ওবায়দুল্লাহকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেছিলাম ওবায়দুল্লাহকে নিয়ে ভালো করে তদন্ত করতে। আমি চাই না এ ঘটনায় কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি বা শাস্তি দেয়া হোক। সে বিএনপি করুক আর যে দলই করুক।

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের ১৬ জুন শহরের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ অফিসে দেশের অন্যতম নৃশংস বোমা হামলার ঘটনায় মারা যান ২০ জন। সেদিন আহত হয়েছিলেন ওই সময়ের ও বর্তমান এমপি শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক মানুষ। তাদের অনেকেই এখন পঙ্গুত্বের জীবন কাটাচ্ছেন। বোমা হামলার পরের দিন বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি খোকন সাহা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় দুটি মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে একটি বিস্ফোরক আইনে ও অন্যটি হত্যা মামলা।

মামলায় জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা) অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে প্রধান করে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের মোট ২৭ জনকে আসামি করা হয়।

ঘটনার প্রায় ২২ মাস পর ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে বোমা হামলার দুই মামলার ফাইনাল রিপোর্টে বলা হয়, ‘উল্লেখিত ২৭ জনের কেউই চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে ১৬ জুন ২০০১ সালের বোমা হামলায় জড়িত নয়।’

প্রায় ছয় বছর মামলাটি হিমাগারে থাকার পর সিআইডির আবেদনে ২০০৯ সালের ২ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে মামলাটি নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারকে আদেশ দেন। ঘটনার দীর্ঘ ১২ বছর পর দুটি মামলায় ২০১৩ সালের ২ মে ৬ জনকে অভিযুক্ত ও ৩১ জনকে অব্যাহতি প্রদান করে দুটি মামলার প্রত্যেকটির ৯৪৭ পাতার চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিটে অভিযুক্ত ৬ জন হলেন- নারায়ণগঞ্জে ক্রসফায়ারে নিহত যুবদল ক্যাডার মমিনউল্লাহ ডেভিডের ছোট ভাই শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, ওবায়দুল্লাহ রহমান, ভারতের দিল্লি কারাগারে আটক সহোদর আনিসুল মোরসালিন, মুহিবুল মুত্তাকিন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু; যিনি একই সঙ্গে মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। অভিযুক্তদের মধ্যে জামিনে থাকা কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু ও ওবায়দুল্লাহ রহমান ছাড়া অন্যরা গ্রেফতার রয়েছে।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *